জঙ্গল-পথে কিরণ কেশরবাণী। নিজস্ব চিত্র
জঙ্গল বেশ গভীর। এক সময় দিনের আলোতেও চুরি-ছিনতাই হত। মাওবাদী-পর্বে ছিল ‘বনপার্টি’র লোকেদের আনাগোনা। আর হাতি বা অন্য বন্যপ্রাণী তো রয়েছেই।
এ সব বাধা-বিপত্তির কথা অবশ্য ভাবার জো নেই কিরণ কেশরবাণীর। সাইকেলে আট কিলোমিটার উজিয়ে তাকে কোচিং স্যরের কাছে পৌঁছতেই হবে। স্যরের স্মার্টফোন আর মোবাইল ইন্টারনেটই যে দ্বাদশ শ্রেণির কলাবিভাগের ছাত্রীর পড়াশোনার একমাত্র ভরসা!
বাঁকুড়া জেলার সারেঙ্গা ব্লকের বিক্রমপুর পঞ্চায়েতের খয়েরপাহাড়ি গ্রামে বাড়ি কিরণের। বাবা সেই ছোটবেলায় ছেড়ে চলে গিয়েছেন। মা সেমা কেশরবাণী দিনমজুরি করে কিরণ আর তার দাদা আকাশকে বড় করছেন। সংসারে রয়েছেন দিদাও। এমন আঁধার ঘরে পড়াশোনার লড়াই ঠিক কতটা কঠিন, জীবন দিয়েই জানে কিরণ। দাদা আকাশ উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেও কলেজে পড়তে পারেনি। আগামী বছর কিরণের উচ্চ মাধ্যমিক। তাই করোনা-কালে লকডাউনের মধ্যেও পড়া কামাই করে না এই কন্যাশ্রী। সবুজসাথীর সাইকেলে চেপে রোজ সকালে সে পড়তে আসে বাঁকুড়া সীমানা লাগোয়া পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গোয়ালতোড় ব্লকের বুলানপুরে। আট কিলোমিটার পথের মাঝে পড়ে কাড়ভাঙার গভীর জঙ্গল। জঙ্গলপথ প্রায় দু’কিলোমিটার।
আরও পড়ুন: অনলাইন ভর্তিতে নয় বিশেষ ‘চার্জ’
কিরণের মা সেমা বলছিলেন, ‘‘খুব কষ্ট করে ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়েছি। এখন স্কুল বন্ধ। অভাবের জন্য মেয়েকে বড় ফোন কিনে দিতে পারিনি। কিরণ বাধ্য হয়েই অনেকটা দূরে পড়তে যায়। পথে জঙ্গল। ভয় হয়। কিন্তু উপায় কী!’’ শুধু স্মার্টফোনের অভাব নয়, কিরণদের এলাকায় ইন্টারনেট পরিষেবাও খুব দুর্বল। ব্যাগ থেকে সাবেক ছোট ফোন বার করে কিরণ বলে, ‘‘দেখুন, সকাল থেকে টাওয়ারই নেই।’’ ইন্টারনেট সমস্যার জন্য কিরণদের স্কুলে অনলাইন ক্লাস হচ্ছে না। খয়েরপাহাড়ি গাড়রা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক রজতকান্তি সৎপথী ফোনে বললেন, ‘‘নেটওয়ার্কের সমস্যার জন্য স্কুল থেকে অনলাইনে পড়ানোর ব্যবস্থা করা যায়নি। ফলে, কিরণদের মতো বহু ছাত্রছাত্রীই অনেক দূরে গিয়ে কোচিং নিচ্ছে, অনলাইন ব্যবস্থায় পড়ছে।’’ সমস্যার কথা মানছেন বিক্রমপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান লক্ষ্মণ কিস্কুও।
এমন সঙ্কটে বুলানপুরের স্টাডি সেন্টারের শিক্ষক দীনবন্ধু দে-ই ভরসা কিরণদের। বুলানপুরের এই স্টাডি সেন্টারে প্রত্যন্ত এলাকার অভাবী পরিবারের অনেক ছাত্রছাত্রীই পড়তে আসছে। দীনবন্ধু বলেন, ‘‘প্রত্যন্ত এলাকার মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের অনেক পড়ুয়া এখানে এসে স্টাডি মেটিরিয়াল নিয়ে যাচ্ছে। অনলাইনে বিষয়ভিত্তিক টাস্ক জোগাড় করে ওদের দিচ্ছি। চেষ্টা করছি যতটা সম্ভব সাহায্য করতে।’’
স্যরের স্মার্টফোন নিয়ে শিক্ষা দফতরের ওয়েবসাইট দেখে প্রশ্নোত্তর, দরকারি তথ্য লিখে নেয় কিরণ। বিষয়ভিত্তিক ‘অ্যাক্টিভিটি টাস্ক’ও খাতায় লিখে নেয়। তার পর দীনবন্ধুবাবুর স্মার্টফোনে অন্য স্যরেদের সঙ্গে ফোনে ‘কনফারেন্স ক্লাস’। তার পর আবার ৮ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে গ্রামে ফেরা। সেখানে কিরণের অপেক্ষায় থাকে কয়েক জন সহপাঠী। তাদের ভরসা কিরণের খাতায় লেখা পাঠ।
তাই কিরণ জানে, তার দায়িত্ব অনেক। দ্রুত বাড়ি ফিরতে সাইকেলের প্যাডলে চাপ দেয় সে। বইয়ের ব্যাগ কাঁধে নিতে নিতে অষ্টাদশী বলে, ‘‘পড়াশোনার জন্য কষ্ট তো করতে হবে। আর মা বলেছে অন্ধকার পেরোলেই রয়েছে আলো। আমার নামের মানেও তো আলোই।’’