নমাজ পড়ছেন সস্ত্রীক মোকসেদ আলি। জলপাইগুড়িতে। ছবি: সন্দীপ পাল
অনাথ, ঘরহারা মেয়েরা রয়েছে অনুভব হোমে। তাদের নিত্য খোরাকির জন্য চাই চাল আর আলু। এইটুকুই জানতে পেরেছিলেন মোকসেদ আলি। আর দেরি করেননি। উঠোনের এক কোণে রাখা ভ্যান টেনে নিয়ে, দু’বস্তা আলু (মোট ৮০ কেজি) তাতে চাপিয়ে রওনা দিলেন ২০ কিলোমিটার দূরে জলপাইগুড়ির হোমটির দিকে। সে দিন ছিল শুক্রবার।
এত তাড়াহুড়ো কেন? মোকসেদ বলেন, ‘‘পর দিন রমজান পড়ে যাবে। দিনভর নির্জলা উপোস করার পরে শরীর দুর্বল থাকে। যদি মাথা ঘুরে পড়ে যাই! তাই আগেই দিয়ে দিলাম।’’
মোকসেদের চাষ করা আলু, কিন্তু খেত তাঁর নিজের নয়। অন্যের খেতে ভাগচাষ করেন তিনি। তাতে অবশ্য চার জনের সংসার চলে না। তাই পুরনো পিচবোর্ড, থার্মোকলের বাক্স, শিশি-বোতলও বিক্রি করেন তিনি। এক কথায় রদ্দিওয়ালা। তবু পরিবারকে টানতে পারেন না ঠিকঠাক। শহর ছাড়িয়ে খুনিয়ারহাটে মাদ্রাসার পিছনে ফুটোয় জর্জরিত টিন চালা আর ততটাই ফুটিফাটা বেড়া দিয়ে ঘেরা একফালি জায়গা। সেটাই মোকসেদের ‘বাড়ি’। উঠোনের দু’দিকে দুটো ছাপরা ঘর। একটিতে রান্না হয়, অন্যটিতে চাপাচাপি করে এক ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন মোকসেদ।
আরও পড়ুন: সংক্রমিত স্বাস্থ্যকর্তার মৃত্যু রাজ্যে, এই মুহূর্তে আক্রান্ত ৪৬১
অভাব এতটাই মাথার উপরে চেপে বসেছে যে, ছেলেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানোর পরে স্কুল ছাড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু মেয়ে মনোরার পড়া বন্ধ করেননি মোকসেদ। একাদশ শ্রেণিতে পড়ছে মনোরা। মোকসেদ বলেন, “মেয়েটার পড়াশোনা জানা জরুরি।” খুঁড়িয়ে হাঁটেন তিনি। বছর পনেরো আগে বাঁ পায়ে ক্ষত হয়েছিল। চিকিৎসা হয়নি সে ভাবে। আঙুল বেঁকে গিয়েছিল তখনই। অস্ত্রোপচার করতে বলেছিলেন ডাক্তারেরা। টাকার অভাবে হয়ে ওঠেনি। এখন খুঁড়িয়ে হাঁটেন। ওই ক্ষত নিয়েই ভ্যানও চালান।
মুখের হাসিটা অবশ্য মোছেনি। হেসেই বলেন, ‘‘কষ্ট হয় তো! কী করব বলুন।’’ সেই হাসি নিয়েই বলতে থাকেন, ‘‘সুরভী বসু নামে আমার এক ম্যাডাম আমাকে অনেক সাহায্য করেন। তিনি একটি সংগঠনেও যুক্ত। তাঁর কাছ থেকে প্রথমে জানতে পারি, তাঁরা ৭০ জন দুঃস্থকে লকডাউনে সাহায্য করবেন। সকলকে ১ কেজি করে আলু দেওয়া হবে। সেই আলু আমার থেকে কেনেন তাঁরা। তখনই আমার মনে হল মানুষ হিসেবে আমারও তো কর্তব্য আছে। প্রতি প্যাকেটে অতিরিক্ত হাফ কেজি করে আলু ভরে দিলাম। তার দাম আমি নিইনি।”
আরও পড়ুন: কোভিড-১৯ রোগীর মন ভাল রাখতে ভিডিয়ো কল
হাসছেন মোকসেদ। সে ভাবেই আবার বলেন, “মানুষকে সাহায্য করার একটা নেশা আছে। ম্যাডামের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আর কোথায় সাহায্য করা যায়! তিনিই বললেন জলপাইগুড়ির হোমের কথা।” তখনই মনস্থির করেন, রমজান মাস শুরু হওয়ার আগেই পৌঁছে দেবেন দু’বস্তা আলু। কথা বলতে বলতে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘‘আজানের সময় হয়ে গেল।’’ দাওয়ায় ছোট্ট কাপড়টা পাততে পাততে বলেন, ‘‘রমজানে দুর্বল হয়ে পড়লে যদি না পারি! লকডাউনের বাজারে মেয়েগুলো যদি খেতে না পায়! মনোরার মুখের দিকে তাকালাম। মনে হল, এখনই যেতে হবে। বার হয়ে পড়লাম ভ্যানটা নিয়ে।’’
মাইকে আজান শোনা যাচ্ছে। মোকসেদ ও তাঁর স্ত্রী হালিমা নমাজ পড়ছেন। বিড়বিড় করে প্রার্থনাও করছেন। তার মধ্যেও হাসি লেগে রয়েছে ভাগচাষি মোকসেদের মুখে।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)