ফাইল চিত্র।
হুকিং-সহ বিদ্যুৎ সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ে অতীতে পৃথক পৃথক নজরদারির পরিকল্পনা সত্ত্বেও কাজ যে বিশেষ হয়নি, সম্প্রতি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পরের পর মৃত্যুর ঘটনাই তার প্রমাণ। এই অবস্থায় মঙ্গলবার বিদ্যুৎ দফতর, সিইএসসি, কলকাতা পুরসভা-সহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলিকে নিয়ে বৈঠক করেন মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী। তাঁর নির্দেশ, শুধু মিটার লাগিয়ে ক্ষান্ত হলে চলবে না। তার রক্ষণাবক্ষণ, পর্যাপ্ত নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে। কী ভাবে বিদ্যুতের তার ও মিটার লাগালে দুর্ঘটনা এড়ানো যাবে, তার রূপরেখা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পুলিশ ও দমকলকে। একটি মিটার থেকে একাধিক লাইন টানা বা হুকিং রুখতে প্রশাসন যে কড়া হবে, তা-ও স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ সংস্থাগুলির বক্তব্য, পুরসভা বা স্থানীয় প্রশাসনের বাতিস্তম্ভে বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়ার পরে রক্ষণাবক্ষণের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট পুরসভা বা স্থানীয় প্রশাসনেরই। শহরে পুরনো বাতিস্তম্ভগুলির রক্ষণাবেক্ষণে যে খামতি রয়েছে, তা স্বীকার করেছেন কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ (আলো) সন্দীপরঞ্জন বক্সী। তিনি বলেন, ‘‘শহরে বাতিস্তম্ভে বার বার বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনায় আমরা পুরসভার আলো বিভাগের সব ইঞ্জিনিয়ারকে সতর্ক করে দিয়েছি। এ বার থেকে সব ওয়ার্ডে ইঞ্জিনিয়ারেরা বাতিস্তম্ভ পরীক্ষা করবেন। কোথাও পুরনো বাতিস্তম্ভ থেকে কোনও তার বেরিয়ে থাকলে সঙ্গে সঙ্গে মেরামত করতে হবে। এখন আরও বেশি সচেতন হতে হবে আমাদের।’’
বিদ্যুৎস্পর্শে পরপর প্রাণহানি নিয়ে ফের সরব বিরোধীরা। রক্ষণাবেক্ষণে সরকারি তরফে নজর না-দেওয়ার অভিযোগের পাশাপাশি দাবি উঠেছে, বিদ্যুতের তার মাটির তলা দিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। এই নিয়ে সোমবার বৈঠক করেন বিদ্যুৎমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। তিনিও নজরদারি বাড়ানোর উপরে জোর দেন।
প্রশাসনিক সূত্রের বক্তব্য, অনেক ক্ষেত্রেই মিটার লাগিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে যায় বিদ্যুৎ সংস্থা। অথচ অনেক ক্ষেত্রেই পরে সেই মিটার থেকে দেদার লাইন টানা হয়। অর্থাৎ নজরদারিতে ফাঁক ও ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ। রাজ্য সরকার এ দিনের বৈঠকে বুঝিয়ে দিয়েছে, এই সব দিকে সতর্ক নজর রাখার দায়িত্ব বিদ্যুৎ সংস্থারই। বিদ্যুতের তার টাঙানোর ক্ষেত্রে ভাল মানের পাইপ ব্যবহারের উপরে জোর দেওয়া হয়েছে। তার ঝুলে গিয়ে যাতে বিপত্তি না-ঘটে, সেই জন্যই এই ব্যবস্থা। রাজ্যের নির্দেশ, লাইসেন্সপ্রাপ্ত ঠিকাদারদের দিয়েই এই সব কাজ করাতে হবে। বিদ্যুৎকর্মীরাও যাতে প্রশিক্ষিত হয়ে ওঠেন, নিশ্চিত করতে হবে তা-ও। কোন উচ্চতায় কী ভাবে বিদ্যুতের তার ও মিটার লাগালে দুর্ঘটনা এড়ানো যাবে, তার রূপরেখা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পুলিশ ও দমকলকে। তার ভিত্তিতে নির্দিষ্ট রূপরেখা চূড়ান্ত করতে পারে নবান্ন।
কলকাতা পুরসভার ভূমিকা নিয়েও এ দিন দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর, প্রশাসনিক কর্তারা লক্ষ করেছেন, শুধু নতুন আলো লাগানোতেই বেশি নজর দিচ্ছে পুরসভা। কিছুটা খামতি থেকে যাচ্ছে পুরনো কাজের রক্ষণাবক্ষণে। অনেক জায়গায় রাস্তার আলো যে জ্বলছে না, এ দিন সেই তথ্য তুলে ধরে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে।
বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেন, ‘‘নতুন কিছু তো তৈরি হচ্ছেই না, রক্ষণাবেক্ষণও নেই। অনেক রাজ্যে ছোট পুরসভা এলাকাতেও বিদ্যুতের তার মাটির তলা দিয়ে টানা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে শুধু দিঘা ছাড়া কোথাও সেটা হয়নি। মোদী সরকার এর জন্য পরিবেশ মন্ত্রকের মাধ্যমে বিশ্বব্যাঙ্কের সাহায্যে ‘সফ্ট লোন’ বা সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করেছিল। আমি মাস ছয়েক রাজ্যে পরিবেশ দফতরের মন্ত্রী ছিলাম। কিন্তু রাজ্য সরকার এই ব্যাপারে কোনও উৎসাহই দেখায়নি।’’ সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর প্রশ্ন, বিদ্যুৎস্পর্শে পরপর প্রাণহানি ঘটল। কলকাতাতেই হরিদেবপুর, নারকেলডাঙা, তার পরে আবার ট্যাংরা। গাফিলতি কার? এর দায় কে নেবে? রক্ষণাবেক্ষণ বলে কিছু নেই। টাকা যতটুকু আসছে, তা-ও লুট হচ্ছে। বিদ্যুতের দাম তো যথেষ্ট। কত টাকা সরকার আদায় করছে এবং তার মধ্যে কত টাকা রক্ষণাবেক্ষণে খরচ হচ্ছে, সে-দিকে নজর কোথায়?
প্রশাসনিক সূত্রের খবর, হুকিং রুখতে আইন কঠোর ভাবে প্রয়োগের কথা ভাবা হচ্ছে। দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাজে অবহেলা বরদাস্ত করা হবে না বলে এ দিন স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছে।