‘বিনামূল্যে সামাজিক সুরক্ষা যোজনা’-র এক কোটি সাড়ে চৌত্রিশ লক্ষ গ্রাহক, সকলের কিস্তির টাকা বহন করছে রাজ্য সরকার।
ফাইল চিত্র।
বইপত্র চিরকাল সরস্বতীর দফতর, কিন্তু এ বছর কলকাতা বইমেলায় ‘সেলফি পয়েন্ট’ হয়ে উঠেছিল মস্ত এক লক্ষ্মীর ঝাঁপি। রাজ্য সরকারের ওই মণ্ডপের অনুপ্রেরণা অবশ্যই ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার।’ বই-বিলাসী কলকাতাবাসীর প্রিয় বিচরণভূমিতে ওই মস্ত নির্মাণ যেন ঘোষণা করছিল, সরকারি প্রকল্প নাগরিক জীবনে আর প্রান্তিক নয়, তা এখন বাংলার রাজনীতি-অর্থনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতির একেবারে কেন্দ্রে। দেড় কোটিরও বেশি মহিলা ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-এর গ্রাহক। গত আর্থিক বর্ষে দশ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে, যা নগরোন্নয়ন (৭৪৬৯ কোটি), পরিবহণ (৪৫৮৯ কোটি) বা পুলিশ (৮৯২৩ কোটি) খাতের চাইতে বেশি।
তার সঙ্গে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন প্রকল্প। যেমন, রাজ্য সরকারের বিধবা ভাতা, লক্ষ্য রাজ্যের একুশ লক্ষ মহিলা। শুরু হয়েছে তফসিলি জাতি ও জনজাতিদের জন্য বার্ধক্য ভাতা, সম্পূর্ণ রাজ্য সরকারের অর্থে। অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড প্রকল্পের গ্রাহকদের যে টাকা দিতে হত (মাসে পঁচিশ টাকা), ২০২০ থেকে তা মকুব করা হয়েছে। ‘বিনামূল্যে সামাজিক সুরক্ষা যোজনা’-র এক কোটি সাড়ে চৌত্রিশ লক্ষ গ্রাহক, সকলের কিস্তির টাকা বহন করছে রাজ্য সরকার। অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকারের বিশ্লেষণ, চলতি অর্থবর্ষে রাজ্য বাজেটে চল্লিশ হাজার কোটি টাকার বেশি— মোট খরচের প্রায় চোদ্দো শতাংশ— লক্ষ্মীর ভান্ডার, কৃষকবন্ধু, স্বাস্থ্যসাথী, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, শস্যবিমা ইত্যাদি তেরোটি প্রকল্পে বরাদ্দ করা হয়েছে। স্পষ্টতই, দরিদ্র ও নিম্নবিত্তের মধ্যে প্রভিডেন্ট ফান্ড, পেনশন, বিমা এবং বিভিন্ন অনুদানের মাধ্যমে সামাজিক সুরক্ষার বিস্তার বাড়াচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বিরোধীরা বলছেন, এ হল জনমোহিনী রাজনীতি। সমর্থকেরা বলছেন, কর্মহীনতার জেরে দারিদ্র বাড়ছে, তাই সম্পদের গণবণ্টন ন্যায্য। গ্রামের শ্রমজীবী মানুষের নালিশ, এ সব হল নিজেদের লোককে টাকা পাইয়ে দেওয়ার কল। আর সরকারি কর্মীদের প্রশ্ন, এই সব প্রকল্প হচ্ছে কার সুরক্ষার মূল্যে? সরকারি কর্মীদের ডিএ দীর্ঘ দিন বকেয়া, কলকাতা পুরসভার কর্মীদের পেনশন বন্ধ, বহু শিক্ষক অবসরের পরে পেনশন পাচ্ছেন না। এই কি সামাজিক ন্যায়?
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত থেকে অবশ্য স্পষ্ট যে তিনি আইনি অধিকারের সুরক্ষার চাইতে, অধিকজনের মধ্যে সম্পদবণ্টনে অধিক বিশ্বাসী। তাই চুক্তি নিয়োগও বাড়ছে। মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এক পরামর্শদাতা বলেন, “একটা স্থায়ী চাকরির জায়গায় তিনটি চুক্তি-ভিত্তিক চাকরি দেওয়া যায়, তিনটি পরিবারের প্রতিপালন হয়। তাই তাতেই মমতা বেশি উৎসাহী।” সম্প্রতি স্বাস্থ্য পরিষেবার নানা পদে এগারো হাজার নিয়োগের ঘোষণা করেছে রাজ্য, সবই চুক্তিতে। এখানেও ন্যায্যতার দাবি ধাক্কা খায় দুর্নীতিতে— স্থায়ী-অস্থায়ী, সব চাকরির পথের কাঁটা ঘুষের দাবি। “তিন লাখ টাকা চেয়েছিল পার্টির দাদা, তাই প্রাইমারিতে পড়ানোর পরীক্ষায় পাশ করেও চাকরি হল না। এখন বিড়ি বাঁধি,” মে দিবসের সভায় বললেন বাগদার পাবর্তী হালদার।
যেখানে যোগ্য প্রাপক সরকারি সহায়তা পাচ্ছে, সেখানেও কি প্রকল্প তার লক্ষ্যপূরণ করতে পারছে? ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্পে বছরে দেড় হাজার কোটি টাকারও বেশি খরচ হয়, তবু পশ্চিমবঙ্গে নাবালিকা বিবাহ, অকালমাতৃত্বের হার হতাশাজনক, মেয়েদের বিয়ের গড় বয়স অধিকাংশ রাজ্যের চাইতে বেশি। তেমনই, ২০১৬ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত মোট ৫৮৭ জন নির্যাতিতাকে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে রাজ্য (মোট ষোলো কোটি টাকা), তাদের অধিকাংশই নাবালিকা। হিংসাশ্রয়ী রাজনীতি ক্রমাগত মেয়েদের আক্রমণ করবে, পুলিশ-প্রশাসন সাক্ষীগোপাল হয়ে থাকবে, আর করদাতার টাকা দিয়ে নিপীড়িতাদের সহায়তা করা হবে— এ কেমন নীতি? বগটুই, নদিয়া সে প্রশ্নকে আরও গাঢ় করল। (চলবে)