মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
রাজ্যের শাসক শিবিরের প্রায় প্রতি মঞ্চ থেকেই অভিযোগ ওঠে কেন্দ্রীয় বঞ্চনার। অভিযোগ, অন্তত দু’টি প্রকল্পে কেন্দ্রের টাকা পাওয়া যাচ্ছে না (কেন্দ্রের দাবি, নিয়ম না মানার জন্যই টাকা দেওয়া হচ্ছে না)। অথচ প্রশাসনের একটি সূত্র থেকে জানা গিয়েছে, কেন্দ্র থেকে আসা পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের বিপুল পরিমাণ টাকা দীর্ঘদিন ধরেই জমে পড়ে রয়েছে রাজ্যের কাছে। এখন সেই জমে থাকা বরাদ্দ (গত অর্থ বর্ষের জমে থাকা বরাদ্দ এবং নতুন অর্থ বর্ষের বরাদ্দ) খরচ করা কার্যত মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজ্য সরকারের কাছে। অবস্থা এমনই বেগতিক যে, সেপ্টেম্বর মাসের শেষ পর্যন্ত রাজ্যে (কলকাতা ছাড়া বাকি ২১টি জেলায় সম্মিলিত ভাবে) প্রতি দিন ৬০ কোটি টাকা করে খরচ করতে হবে বলে লক্ষ্যমাত্রা নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল নবান্ন।
তবে প্রশাসনিক সূত্রের খবর, সেই নির্দেশের পরেও গত প্রায় তিন সপ্তাহে দৈনিক ৬০ কোটি টাকা করে খরচ করা যায়নি। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, অব্যবহৃত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২২৮২ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত কয়েক সপ্তাহে সম্মিলিত ভাবে সব জেলার খরচ হয়েছে ১৯২ কোটি টাকা। এক কর্তার কথায়, “দৈনিক ৬০ কোটি টাকা খরচ করা কার্যত অসম্ভব। কারণ, এই প্রকল্পে বেশির ভাগ কাজই দুই-তিন লক্ষের মতো অল্প টাকার। ফলে এত টাকা খরচ করতে যে কাজ করতে হবে, তা হাতে নেই। তাই মাথা খাটিয়ে অভিনব কাজ বের করা জরুরি।”
প্রশাসন সূত্রের খবর, নবান্নের নির্দেশের পর তুলনায় খরচের হার কিছুটা বাড়লেও, পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের বরাদ্দের পূর্ণ ব্যবহার এখনও কার্যত অধরা। প্রধানমন্ত্রী আবাস বা একশো দিনের কাজের মতো প্রকল্পে বরাদ্দ এখনও বন্ধ থাকলেও, পঞ্চদশ অর্থ কমিশনে বরাদ্দ রয়েছে অবাধ। চলতি আর্থিক বছরের (২০২৩-২৪) প্রথম কিস্তির প্রায় ১৭০০ কোটি টাকাও দিয়েছে কেন্দ্র। প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের অনেকের মতে, লোকসভা ভোটের আগে খরচে গতি না আনতে পারলে সেটাই আক্রমণের রাজনৈতিক অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে বিরোধীদের কাছে। সেই কারণে দ্রুত খরচের পদ্ধতি ঠিক করে দিতে আসরে নামতে হচ্ছে প্রশাসনের শীর্ষমহলকে।
প্রশাসনিক সূত্রের তথ্য, গত অগস্টের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত সরকারেরই তথ্য বলছে, ২০২০-২১ বছরে হাতে থাকা অর্থের মধ্যে খরচ হয়েছিল প্রায় ৪৪১ কোটি টাকা, শতাংশের হিসাবে যা মাত্র ১৮.৭৩%। ২০২১-২২ বছরে সেই খরচ ছিল ৪৪.২৪%, যা প্রায় ২৫৫২ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ আর্থিক বছরে খরচ হয়েছিল তুলনায় সবচেয়ে বেশি, ৭৯.০২% বা প্রায় ৩৮৩৮ কোটি টাকা। তথ্য অনুযায়ী, এ বছর (২০২৩-২৪) রাজ্যের হাতে এখনও পর্যন্ত রয়েছে প্রায় ৪৩৬৬ কোটি টাকা। কিন্তু সম্প্রতি দেখা যায়, খরচ না হওয়া অর্থের পরিমাণ প্রায় ২৪৭৪ কোটি টাকা। তার পরেই দৈনিক প্রায় ৬০ কোটি টাকা করে খরচের নির্দেশ দেয় নবান্নের শীর্ষমহল।
প্রসঙ্গত, দৈনিক খরচ নিয়ে নবান্নের নির্দেশের পরে পঞ্চায়েতমন্ত্রী প্রদীপ মজুমদার বলেছিলেন, “খরচ হয়নি বলেই জেলাগুলিকে সেই তথ্য জানানো হয়েছে। এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে এসে খরচ করার গতি বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে জেলাগুলিকে। পঞ্চায়েত স্তরে নতুন যে বোর্ডগুলি তৈরি হয়েছে, তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া চলছে। কী ভাবে যথাযথ পরিকল্পনা করে টাকাখরচ করা যায়, তা-ও রয়েছে প্রশিক্ষণের আওতায়।”
আধিকারিক মহলের একাংশের বক্তব্য, গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা পরিষদগুলির জন্য অর্থ কমিশনের বরাদ্দের মধ্যে ৬০ ভাগ টাকা খরচ করা যায় নির্দিষ্ট কাজে (টায়েড ফান্ড)। সেই ৬০ ভাগের অর্ধেক জল সরবরাহ, জল পরিশোধনের পরিকাঠামো নির্মাণে খরচ করতে পারে সরকার। বাকি অর্ধেক খরচ করা যায় কঠিন, তরল, প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিকাঠামো এবং শৌচাগার নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে। বাকি ৪০ ভাগ অর্থ অন্যান্য কাজে (আন-টায়েড) খরচ করার সুযোগ রয়েছে। আবার জলজীবন বা স্বচ্ছ ভারত মিশনের মতো প্রকল্পের অর্থও রয়েছে এই সব কাজে। তাই প্রকল্পের ভাবনায় নতুনত্ব না আনা গেলে, সময়ের মধ্যে পুরো বরাদ্দ খরচ করা বেশ কঠিন বলেই মনে করছে প্রশাসনিক মহল।