রাজ্যের ৭ পুরসভার ভোট নিয়ে হাইকোর্টের নির্দেশের বিরুদ্ধে শেষমেশ সুপ্রিম কোর্টেই গেল রাজ্য সরকার। সোমবার শীর্ষ আদালতে রাজ্যের হয়ে আবেদন পেশ করলেন আইনজীবী তথা কংগ্রেস নেতা কপিল সিব্বল। আজ, মঙ্গলবার শুনানি হবে সেই মামলার। কিন্তু সিব্বল রাজ্যের আর্জি পেশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সকলকে বেশ খানিকটা চমকে দিয়েই ভোটের দিন ক্ষণ ঘোষণা করে দিলেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়। এ দিন সর্বদলীয় বৈঠকে তৃণমূল প্রতিনিধির আপত্তি উপেক্ষা করে তিনি জানিয়ে দেন, ভোট হবে ১৪ জুন। গণনা ১৬ জুন।
রাজ্যের পুর আইন অনুযায়ী পুরভোটের বিজ্ঞপ্তি জারির দায়িত্ব রাজ্য সরকারের। নির্বাচন কমিশন ২০ মে-র মধ্যে বিজ্ঞপ্তি জারি করতে বললেও সরকার যে সে পথে হাঁটবে না, সে কথা এ দিনই স্পষ্ট করে দিয়েছেন পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। তাঁর কথায়, ‘‘রাজ্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছে। তার নিষ্পত্তির আগে আমরা সাত পুরসভার ভোটের তারিখ নিয়ে কোনও বিজ্ঞপ্তি জারি করতে পারব না।’’
বিধাননগর, রাজারহাট-গোপালপুর, বালি, রানিগঞ্জ, কুলটি, জামুড়িয়া ও আসানসোল— এই সাত পুরসভায় ভোট পিছোতে রাজ্য সরকারের আর্জি খারিজ করে হাইকোর্ট গত শুক্রবার নির্দেশ দিয়েছে, ভোট ১৬ জুনের মধ্যে সেরে ফেলতে হবে। সেই নির্দেশ চ্যালেঞ্জ করেই সোমবার সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি এ কে সিক্রি এবং বিচারপতি উদয় উমেশ ললিতের অবকাশকালীন বেঞ্চের দ্বারস্থ হয়েছে রাজ্য। দু’বছর আগে পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন ঘোষণা নিয়ে দ্বন্দ্বের ফয়সালা হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে। সে বার হাইকোর্টের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে রাজ্য নির্বাচন কমিশন গিয়েছিল সর্বোচ্চ আদালতে। এ বার গেল রাজ্য সরকার।
এখন প্রশ্ন হল, সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য মামলা করেছে জেনেও কমিশন ভোটের দিন ঘোষণা করতে গেল কেন? বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে যখন রাজ্য সরকারের নানা অনৈতিক অবস্থানের বিরুদ্ধে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে না-পারার অভিযোগ উঠেছে বারবার। সদ্যসমাপ্ত ৯২টি পুরসভা নির্বাচনে অশান্তি, রক্তারক্তি হলেও নির্বাচন কমিশনার কোনও ব্যবস্থা নেননি বলে অভিযোগ বিরোধীদের। তিনি যে অসহায়, প্রকারান্তরে সে কথা কবুলও করে নিয়েছিলেন সুশান্তবাবু।
সেই সুশান্তবাবু কি এ বার, হাইকোর্টের নির্দেশের পরে, রাজ্যের সঙ্গে সংঘাতে যাওয়ার সাহস দেখাচ্ছেন? কমিশন সূত্র বলছে, হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর কমিশনকে নিজের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করতে বলেছেন। তাঁর নির্দেশ, ১৬ জুনের মধ্যে যাতে সাত পুরসভার ভোটপর্ব সেরে ফেলা যায়, তার প্রক্রিয়া কমিশন চূড়ান্ত করুক। সেই নির্দেশ পালন না করলে আদালত অবমাননার দায়ে পড়তে হতো কমিশনকে। তাই ভোটের দিন ঘোষণা করে গা বাঁচালেন সুশান্তবাবু।
এ দিন সর্বদল বৈঠকে তৃণমূলের প্রতিনিধি তথা কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বারবার কমিশনারকে বলেন, দিনক্ষণ নির্ধারণের আগে তিনি যেন সরকারের সঙ্গে কথা বলে নেন। কমিশনার পাল্টা জানান, নির্বাচনী বিজ্ঞপ্তি জারি করতে বলে রাজ্যকে ইতিপূর্বে তিনটি চিঠি দেওয়া হয়েছে, যার উত্তর মেলেনি। এ দিনও তিনি ফের চিঠি দিয়েছেন।
সাত পুরসভায় ভোট করাতে রাজ্যের এত আপত্তি কেন?
সুপ্রিম কোর্টে পেশ করা আবেদনের যুক্তি: আসানসোল পুরনিগমে কুলটি-রানিগঞ্জ-জামুড়িয়া পুরসভাকে অন্তর্ভুক্ত করতে জারি হওয়া বিজ্ঞপ্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে সোমবারই। আবার বিধাননগর ও রাজারহাট-গোপালপুরকে সংযুক্ত করে এবং হাওড়া পুরনিগমে বালি পুরসভার ওয়ার্ড জুড়ে যে দু’টো পুরনিগম গড়ার বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে, তার মেয়াদ ফুরোবে ৬ জুন। মেয়াদ শেষের পরে রাজ্যপালের সম্মতি পেতে সাধারণত সাত-দশ দিন লাগে। তার দু’চার দিনের মধ্যে সরকার ভোটের দিন ঘোষণা করতে পারে।
এমতাবস্থায় হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে নির্বাচন হলে নতুন সমস্যা দেখা দেবে বলে দাবি করেছেন পুর দফতরের এক কর্তা। তাঁর যুক্তি, পুরনো পুরসভার ভোট হয়ে যাওয়ার পরে যখন নতুন পুরনিগম গঠন হবে তখন সংশ্লিষ্ট পুরসভাগুলির আর অস্তিত্বই থাকবে না। তখন রাজ্য নতুন পুরনিগমের ভোটের দিন ঘোষণা করলে আগের ভোটে নির্বাচিত বেশ কিছু প্রতিনিধির আইনি অবস্থান নিয়ে সংশয় তৈরি হবে। এতে ওঁরা কোর্টে যেতে পারেন, যার ফলে হয়তো গোটা প্রক্রিয়াটাই বিগড়ে যাবে। পুরমন্ত্রীর কথায়, ‘‘হাইকোর্টের রায় মেনে ভোট করলেও জয়-পরাজয়ের মূল্য থাকবে না। কারণ, তত দিনে ওই পুরসভাগুলো পুরনিগমে সামিল হয়ে যাবে। ফের ভোট করাতে হবে।’’
এ হেন সঙ্কটের জন্য অবশ্য রাজ্য সরকারের দিকেই কিন্তু আঙুল তুলছেন পুর দফতরের একাংশ। তাদের বক্তব্য: এক বছর ধরে ব্যাপারটা ঝুলিয়ে রাখার কারণেই সমস্যা দেখা দিয়েছে। ‘‘এই কারণেই সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য সরকার বিড়ম্বনায় পড়তে পারে।’’— মন্তব্য এক আধিকারিকের। হাইকোর্টে সরকার-ঘনিষ্ঠ আইনজীবীদের অনেকেরও অভিমত, সংযুক্তিকরণ প্রক্রিয়া এক বছরেও কেন সম্পূর্ণ হল না, সেই প্রশ্ন তুলতে পারে সুপ্রিম কোর্ট। সময়মতো সাত পুরসভার ভোট না-করে রাজ্য সরকার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে গাফিলতি দেখিয়েছে, এমন কথাও বলতে পারে তারা।
এবং সে ক্ষেত্রে রাজ্য কী জবাব দেয়, তা জানতে ওঁরা যারপরনাই আগ্রহী। নবান্ন-সূত্রের খবর, রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল জয়ন্ত মিত্রকে গোটা প্রক্রিয়ার মধ্যে রাখাই হয়নি। জয়ন্তবাবু এ দিন জানান, তিনি কলকাতায় নেই, সুপ্রিম কোর্টের মামলাটি সম্পর্কেও তাঁর ধারণা নেই। এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে কারও কোনও আলোচনা হয়নি।