মুখ্যমন্ত্রীর হাতে অর্থমন্ত্রীর বাজেট। শুক্রবার বিধানসভায় সুমন বল্লভের তোলা ছবি।
নোট বাতিলের ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে যে ধাক্কা লেগেছে, তা ইদানীং অনুধাবন করছে কেন্দ্র। সে কারণে সংসদে সাধারণ বাজেট ঘোষণা করে গ্রাম-গরিব ও মধ্যবিত্তকে সুরাহা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন মোদী-জেটলি। তবে কোনও ভাবেই ক্ষতিগ্রস্তদের নগদ টাকা পাইয়ে দেওয়ার পথে তাঁরা হাঁটেননি। নোট-সঙ্কটে আক্রান্তদের নগদ অনুদান দেয়নি আর্থিক ভাবে সমৃদ্ধ অন্য কোনও রাজ্যও। সে দিক থেকে মমতা সরকারের এ বারের বাজেট ঘোষণা নজিরবিহীন।
বাজেট পেশ করে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র শুক্রবার বলেন, ‘‘নোটবন্দির জেরে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার দক্ষ কারিগর বাংলায় ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। এঁরা খুবই অসহায় অবস্থায় জীবনযাপন করছেন। তাঁদের অবস্থার কথা ভেবে এই রকম ৫০ হাজার কারিগরের জন্য ৫০ হাজার টাকা করে এককালীন আর্থিক সাহায্যের প্রস্তাব করছি। যাতে তাঁরা ক্ষুদ্র ব্যবসার মাধ্যমে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেন। এ জন্য ২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করছি।’’ এরই পাশাপাশি অর্থমন্ত্রী জানান, নোটবন্দির কারণে রাজ্যের বিপুল সংখ্যক কৃষক সময়মতো জমিতে সার, বীজ ইত্যাদি প্রয়োগ করতে না পারায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বাংলায় কৃষকেরা সমবায়-ঋণের উপরে নির্ভরশীল। কিন্তু নোট-ঝড় এই ঋণ ব্যবস্থার পরিকাঠামোকেও সম্পূর্ণ ভাবে ভেঙে দিয়েছে। সেই সমস্যা নিরসনে ১০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠন করা হবে।
বাজেট বক্তৃতা শেষ হতেই অমিতবাবুকে পাশে নিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন মুখ্যমন্ত্রী। মমতা বলেন, ‘‘যাঁরা কাজ হারিয়ে ফিরে এসেছেন, তাঁদের দুর্ভোগ চোখে দেখা যায় না। আমি একটা কথাই বুঝি। বাড়িতে যদি অতিথি আসে, তাঁদের মাংস খাওয়ানোর ক্ষমতা না থাকলে, ডাল সিদ্ধ-ভাত অন্তত খাওয়াব। বাজেটে সেটাই করেছি।’’ একই ভাবে নোট-ধাক্কায় আক্রান্ত কৃষকদের সমস্যার কথাও তুলে ধরেন মমতা। সেই সঙ্গে বলেন, ‘‘জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কেউ যদি সরকারের মানবিক মুখ দেখতে চান, তা হলে বাংলায় আসতে হবে।’’ এই দুই ঘোষণার পাশাপাশি শিশু কল্যাণ প্রকল্পের আওতায় অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী এবং সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার আওতায় ‘আশা’ কর্মীদের জন্য মাসিক সাম্মানিক ৫০০ টাকা করে বাড়ানোর ঘোষণা হয়েছে বাজেটে।
অর্থনীতির বিশেষজ্ঞেরা অবশ্য একে খয়রাতির দর্শন বলেই সমালোচনা করছেন। এমনকী অনেকের মতে— এমনিতেই চাল-সাইকেল-খাতা-বই-জুতো মিলিয়ে রাজ্যের কোষাগারে খয়রাতির বোঝা বিপুল। তার উপরে সরকারের এ হেন সিদ্ধান্ত বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
তবে পর্যবেক্ষকদের মতে, বাজেট বরাবরই রাজনৈতিক হয়। এমনিতে নোট-বন্দিতে সম্ভাব্য বিপর্যয় নিয়ে সরকার যতটা সুর চড়িয়েছিল, বাজেট পরিসংখ্যানে তার প্রতিফলন সে ভাবে দেখা যায়নি। কিন্তু কেন্দ্রের নোট-সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদকে মমতা যে সপ্তমে বেঁধেছিলেন, তাতে রাজ্য সরকারের কাছে আক্রান্ত পরিবারগুলির প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। মমতার কাছে সেই প্রত্যাশা পূরণ করা ছিল রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা। সেটা করে তিনি নিম্নবিত্ত মানুষের মধ্যে তাঁর জনভিত্তি মজবুত করার চেষ্টা করলেন। রাজ্য বাজেটে কর্মহারাদের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেই মুখ্যমন্ত্রী বোঝাতে চাইলেন তাঁর সে দিনের উদ্বেগ ফাঁপা ছিল না। বিপুল ঋণের চাপে নবান্নের আর্থিক সীমাবদ্ধতা থাকলেও নোট বাতিলের জেরে বিপদে পড়া মানুষের প্রতি বাংলায় তৃণমূল সরকার সহানুভূতিশীল। আবার অনেকের
মতে, ভিন্ রাজ্যে যে বাঙালিরা জরি বা ইমারতি কাজে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই সংখ্যালঘু। মুখ্যমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তের নেপথ্যে সেই রাজনীতি রয়েছে। এখন প্রশ্ন, যে ৫০ হাজার কারিগরকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে, তাঁদের কী ভাবে বাছবে সরকার?
মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, ‘‘ভিন্ রাজ্যে কাজ হারিয়ে কত কারিগর ফিরে এসেছেন, তা খতিয়ে দেখতে জেলাশাসকদের সমীক্ষা করতে বলা হয়েছে। তার ভিত্তিতেই অনুদান দেওয়া হবে। ক্ষতিগ্রস্ত কারিগরের সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি হলেও অসুবিধা নেই।’’ বিরোধীরা সরকারের এই ঘোষণা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন। বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘ক্ষতিগ্রস্ত কারিগরদের কী ভাবে বাছা হবে, সেটাই আসল।
জেলাশাসক যদি বাছাই করেন, তাতে স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের প্রভাব খাটানোর আশঙ্কা থাকবে। এমন হবে না তো যে, এই টাকা ঘুরে তৃণমূলের বাহুবলীদের হাতেই পৌঁছবে?’’