বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়
বিধানসভা কক্ষে সাংবাদিকদের ‘অধিকার’ সম্পর্কে বৃহস্পতিবার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য ঘিরে বিভিন্ন মহল বিস্মিত।
এ দিন সভায় স্পিকার যা বলেন, তার মর্মার্থ— তিনি সভাকক্ষে ঢুকলে বিধায়করা যেমন উঠে দাঁড়ান, কর্তব্যরত সাংবাদিকদেরও সে ভাবে উঠে দাঁড়াতে হবে। বিধানসভার এত বছরের ইতিহাসে কোনও দিন সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রযোজ্য হয়নি। কারণ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূল সভার অংশই নয় প্রেস গ্যালারি বা দর্শকাসন। তাই মূল সভার নিয়ম এ ক্ষেত্রে খাটে না।
ঘড়িতে তখন ১১টা। বিধানসভায় তাঁর আগমনবার্তা ঘোষিত হল— ‘লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, দ্য স্পিকার’। নিয়মানুসারে সভার সদস্যরা উঠে দাঁড়িয়ে স্পিকারের চেয়ারের প্রতি সম্মান জ্ঞাপন করলেন। স্পিকার বিমানবাবু আসন গ্রহণ করার অব্যবহিত পরেই মাইক টেনে নিয়ে বললেন, ‘‘আজ আমি সাংবাদিকদের অ্যালাও করব না!’’
তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘আপনারা কথা বলেন। বিধানসভার নিয়মকানুন মানেন না। অধ্যক্ষ ঢুকলে উঠেও দাঁড়ান না। বিধানসভার চেয়ারকে অপমান করেন। তাই আমি অ্যালাও করব না!’’
গোটা সভা চুপ। স্পিকারের কথা শেষ হতেই সাংবাদিকদের বসার জায়গার পিছন থেকে বিধানসভার রক্ষীদের দু’একজন এসে নিচু স্বরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘এ বার উঠুন, উঠুন!’’ স্পিকারের আদেশ পালন করার জন্য মার্শাল ও আরও কয়েক জন রক্ষীকে সামনের দিক থেকে সাংবাদিকদের দিকে এগোতে দেখে বামপন্থী বিধায়ক মহম্মদ হেদায়েতুল্লা, শাহজাহান চৌধুরী, নিরাপদ সর্দাররা উঠে দাঁড়িয়ে হইচই শুরু করে দেন। শোনা যায় বামপন্থী বিধায়করা স্পিকারকে বলছেন, ‘‘স্যর, আপনি এটা কী করছেন? কেন করছেন? ওঁরা এই সভার সদস্য নন। আপনি সভায় ঢুকলে ওঁরা দাঁড়াতে যাবেন কেন?’’
হইচই, প্রতিবাদের পরে স্পিকার তাঁর নির্দেশ প্রত্যাহার করে বলেন, ‘‘ঠিক আছে, আজকের মতো তা হলে অনুমতি দিলাম!’’
সাংবাদিকদের অধিকার সম্পর্কে স্পিকারের মন্তব্য শুনে পরে পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বিধানসভায় স্পিকারই সর্বেসর্বা। সভার ভিতরে যাঁরা থাকেন, সকলেরই দায়িত্ব তাঁর চেয়ারকে সম্মান জানানো। কিন্তু সাংবাদিকদের অধিকার খর্ব ও তাঁদের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা সরকার সমর্থন করে না।’’ এ দিন স্পিকারের কক্ষে গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথাও বলেন পার্থবাবু। এই বিষয়ে আজ, শুক্রবার বিধানসভায় বিবৃতি দিতে পারেন তিনি।
বিধানসভার বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, ‘‘বিধানসভার বিধি অনুযায়ী, স্পিকার বা সভার কোনও সদস্যই গ্যালারিতে বসে থাকা সাংবাদিক বা দর্শকদের উদ্দেশে কোনও কথা বলতে পারেন না। স্পিকার চাইলে নিজের ঘরে সাংবাদিকদের ডেকে পাঠিয়ে কিছু বলতে পারেন।’’ কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার বক্তব্য, ‘‘স্পিকার বিধানসভায় সর্বশক্তিমান। তাঁর মুখের কথাই আইন। তবে আমি ১৯৮২ সাল থেকে এই সভার সদস্য। সভার নিয়মকানুন কিছুটা হলেও জানি। কোনও দিন এমন রুলিং দেখিনি, শুনিওনি। এ দিনের ঘটনা দেখে আমি অবাক হয়েছি।’’ বিজেপির একমাত্র বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘ঘটনাটি অনভিপ্রেত, নজিরবিহীন।’’
বিধানসভার প্রাক্তন স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিমও জানিয়েছেন, বিমানবাবুর নির্দেশ যথার্থ নয়। হালিমের কথায়, ‘‘স্পিকার কখনও সাংবাদিক বা দর্শকদের বার করে দিতে পারেন না। স্পিকার সভায় ঢুকলে তাঁর চেয়ারকে সম্মান দেখানোর জন্য সাংবাদিকরা উঠে দাঁড়াতে বাধ্য নন। বিশ্বের কোথাও এই ব্যবস্থা নেই!’’ লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমি ভারতের কোনও স্পিকারের নির্দেশ নিয়ে মন্তব্য করি না। তবে লোকসভার নিয়মটা আমি বলতে পারি। স্পিকার সভাকক্ষে ঢুকলে সেখানে গ্যালারিতে থাকা সাংবাদিক বা দর্শকদের উঠে দাঁড়ানোর কোনও নিয়ম নেই।’’