পুরীর ভোগকে ঘিরে বাংলার সঙ্গে রসগোল্লা যুদ্ধ

‘দেবা-দেবী’র পুরনো ঝগড়া। উৎকল ও বঙ্গের পুরনো ঝগড়াও বটে। নবকলেবরের জগন্নাথদেবকে নিয়ে উন্মাদনার আবহে সেই ঝগড়া নতুন করে জেগে উঠেছে।

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০১৫ ০৪:১০
Share:

‘দেবা-দেবী’র পুরনো ঝগড়া। উৎকল ও বঙ্গের পুরনো ঝগড়াও বটে। নবকলেবরের জগন্নাথদেবকে নিয়ে উন্মাদনার আবহে সেই ঝগড়া নতুন করে জেগে উঠেছে।

Advertisement

রসগোল্লার জন্ম বাংলা না ওড়িশায়, কাজিয়া তাই নিয়েই। রথযাত্রার গোড়া থেকেই রসগোল্লা রয়েছে বলে দাবি করে সম্প্রতি আইনি যুদ্ধেও সামিল হয়েছে নবীন পট্টনায়কের সরকার। ভুবনেশ্বরের কাছে পাহালে রসগোল্লার জন্ম হয়েছে বলে জানিয়ে জিওগ্রাফিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন বা ভৌগোলিক পরিচিতির (জিআই) তকমা আদায়ে তারা আর্জি পেশ করতে চলেছে। এর আগে দার্জিলিংয়ের চা, মালদহের লক্ষ্মণভোগ আম, জয়নগরের মোয়ার জন্য জিআই–মর্যাদা আদায় করলেও কলকাতার রসগোল্লা নিয়ে এখনও এগোনো হয়নি বাংলার সরকারের। তবে রাজ্যের ক্ষুদ্র শিল্পমন্ত্রী স্বপন দেবনাথের আশ্বাস, ‘‘রসগোল্লার হক বাংলাও ছাড়বে না। শক্তিগড়ের ল্যাংচা, বর্ধমানের সীতাভোগ-মিহিদানা বা কলকাতার রসগোল্লার ভৌগোলিক স্বত্ত্ব আদায় করে ছাড়ব।’’

রসগোল্লা নিয়ে ওড়িশার দাবির উৎসটি কী? রথযাত্রা শেষে মন্দিরে ফেরার পর গিন্নির মানভঞ্জনে এই রসগোল্লারই শরণাপন্ন হন জগন্নাথ। পুরীর মন্দিরে বছরের এই একটি দিনই বাইরে তৈরি ভোগ ভিতরে ঢোকে। যেমন বৃহস্পতিবার সন্ধেয় প্রায় দু’হপ্তার ছুটি কাটিয়ে ঘরে ফিরলেন মহাপ্রভু। রীতিমাফিক এ দিন সকাল থেকেই রসগোল্লার ছড়াছড়ি তাঁর রথ নন্দীঘোষে। লক্ষ্মীর সেবায়েতদের বাধা টপকে বহু কষ্টে জগন্নাথদেব যখন মন্দিরে ঢোকেন, এই রসগোল্লাই যেন তাঁর পাসওয়ার্ড। নইলে বোন সুভদ্রা ও দাদা বলভদ্রের পরে জগন্নাথ ঢুকতে গেলেই সিংহদুয়ার আটকে রুখে দাঁড়ান মা-লক্ষ্মীর প্রতিনিধিরা। আগে দেবদাসীরা দরজা আটকাতেন। এখন পরম্পরা মেনে মন্দিরের সেবায়েতদের একাংশই লক্ষ্মীর হয়ে ঝগড়া করেন! কেন স্ত্রীকে ফেলে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন মহাপ্রভু! জগন্নাথের প্রতিনিধি মুখ্য দয়িতাপতি জগন্নাথ সোয়াঁইন মহাপাত্র তাঁদের বোঝান, ভাশুরঠাকুর বলরাম যেখানে রয়েছেন, সেখানে মা-লক্ষ্মীর যাওয়াটা কী করে শোভা পায়! লক্ষ্মীর দলের পাল্টা যুক্তি, বোন সুভদ্রা সঙ্গে যেতে পারলে মা-লক্ষ্মীর যেতেই বা কী অসুবিধে ছিল?

Advertisement

রীতিমাফিক এই তর্কে হার হয় জগন্নাথের প্রতিনিধিরই। স্বয়ং মহাপ্রভু মন্দিরে ঢুকতে না-পেরে বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন বলে এক সময়ে চোখের জল ধরে রাখতে পারেন না মুখ্য দয়িতাপতি। পরের বার এমন ভুল আর করবেন না-বলে স্বামীর তরফে আশ্বাস পেয়ে তবে মন গলে লক্ষ্মী ঠাকরুণের। মন্দিরের রত্নভাণ্ডারের কাছে লক্ষ্মী-নারায়ণের পুষ্পাঞ্জলি পুজোর পরেই রসগোল্লা-ভোগ স্ত্রীকে অর্পণ করেন জগন্নাথ। পুরী মন্দিরের এই ট্র্যাডিশনকে হাতিয়ার করেই ওড়িশার দাবি, রসগোল্লা আসলে উৎকলজাত।

স্বাভাবিক ভাবেই এতে আঁতে ঘা লাগছে আমবাঙালির মনে ‘রসগোল্লার কলম্বাস’ বলে খ্যাত নবীন দাশের বংশধর তথা কে সি দাশের কর্তাদের। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে দরবার করতে সংস্থার অন্যতম কর্তা ধীমান দাশ কোমর বাঁধছেন। তাঁদের হিসেব মতো, ১৮৬৮ সালে বাগবাজারের দোকানেই ধবধবে স্পঞ্জ রসগোল্লার উদ্ভাবন ঘটান ‘নবীন ময়রা’। আর তিন বছর বাদে সেই কীর্তির সার্ধশতবর্ষ পালনের মুখেই জগন্নাথদেবকে সামনে রেখে রসগোল্লা-গৌরব ছিনিয়ে নিতে চাইছে ওড়িশা। তবে ওড়িশার নামজাদা রসগোল্লা-নির্মাতা, কটকের কাছে সালেপুরের বিকলানন্দ করের দোকান বয়সে কে সি দাশের থেকে নবীন। কিন্তু করেদের দোকানের কর্তা প্রশান্তকুমার কর বা ওড়িশার জগন্নাথ-বিশেষজ্ঞ সুরেন্দ্রনাথ দাশ— সবারই দাবি, রসগোল্লা সৃষ্টি জগন্নাথধামের প্রাচীন ঐতিহ্য। ঐতিহ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন না ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্র। কিন্তু তাঁর সংশয়, ‘‘পুরীর রথের সাবেক রসগোল্লা কি ছানার ছিল? নাকি গুড় বা ক্ষীরের গোল্লা ছিল, তা প্রমাণ হয়েছে?’’ ওড়িশার বিশেষজ্ঞদের দাবি, জগন্নাথধামে ক্ষীরমোহন নামে এক ধরনের মিষ্টিই রসগোল্লার পূর্বপুরুষ। ওড়িশার রসগোল্লা স্বাদে বাংলার থেকে খানিকটা মিষ্টি, কিছুটা ঘিয়ে-রঙা ও শক্ত। ওড়িশার দাবি, সে-রসগোল্লাই পরে বাংলায় ঢুকেছে।

এই তত্ত্বের বিপরীতেও কিছু যুক্তি রয়েছে। বিক্রমাদিত্য-পার্ষদ অমর সিংহের ‘অমরকোষ’ সাক্ষী, উষ্ণ দুধে দধিযোগে বিকৃতির নামই ছানা। দুধ ‘ছিন্ন’ করে সৃষ্ট ছানা প্রধানত বাঙালি ছাড়া বাকি ভারত দেবতার ভোগের উপযুক্ত বলে মনে করত না। এই যুক্তিতেই জগন্নাথধামের সাবেক মিষ্টি আর বাঙালির রসগোল্লা এক নয় বলে দাবি করছেন মিষ্টি নিয়ে দীর্ঘদিন লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হরিপদ ভৌমিক। ‘শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত’ প্রমুখ গ্রন্থে জগন্নাথদেবের ভোগের ফিরিস্তির তালিকা ঘেঁটেও হরিপদবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘কই তাতে তো রসগোল্লার নামোল্লেখ নেই?’’

পর্তুগিজ পাদ্রিদের ‘পট চিজ’ তৈরির কায়দা থেকেই সন্দেশ-রসগোল্লার উপাদান, জমাট-বাঁধা ছানা তৈরির কসরত রপ্ত করে বাঙালি। তার পরই ক্রমশ ধাপে-ধাপে আজকের পরিশীলিত চেহারা পায় রসগোল্লা। ঔপনিবেশিক ভারতের খাদ্য ইতিহাস বিষয়ে গ্রন্থপ্রণেতা উৎসা রায়ের মতে, ‘‘কোনও খাবারের সঙ্গে জাতিগত পরিচয় খোঁজার চেষ্টাটাই অনেকাংশে আরোপিত। খাঁটি বাঙালি বা ওড়িয়া রসগোল্লা বলে কিছু হয় না।’’
বাঙালি ও উৎকলীয় ভক্তদের মধ্যে একযোগে সুপরিচিত পুরীর মন্দিরের মুখ্য দয়িতাপতিও অনেকটা একই সুরে বলছেন, ‘‘এ-সব বাজে তর্ক! বাংলায় মা-কালী, ওড়িশায় মহাপ্রভু। ভেদটা কীসের!’’

বাস্তবিক স্থানীয় ময়রাদের পিছনে ফেলে কলকাতার বাঞ্ছারাম এখন জগন্নাথদেবের রসগোল্লা ভোগ গড়তে পুরীতে ঘাঁটি গেড়েছে। কারিগরদের হাতে শুদ্ধাচারে তৈরি হাজার হাজার রসগোল্লা প্রভুর রথ থেকে তাঁর সঙ্গী হয়ে মন্দিরের ভিতরে ঢুকে পড়েছে। আর জগন্নাথদেবের মন্দিরে প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে-সঙ্গে গোটা পুরী জুড়েই দোকানে-দোকানে রসগোল্লার জয়জয়কার। কুলীন খাজা-গজাকে সরিয়ে এই ক’দিন শ্রীক্ষেত্র যেন রসগোল্লা-নগরী।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement