প্রতীকী ছবি।
সবাই এখন লেট-লতিফ। সবাই এখন দেরিতে আসে। কোনও কিছুই যেন সময় মেনে হাজির হয় না। আবার খামখেয়ালির বশে পুরো মেয়াদ থাকার চেষ্টাও করে। তখনই আগের সঙ্গে পরের আর পরের সঙ্গে আগের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। দ্বন্দ্ব মানে ঝগড়া, আবার মিথুনও। দু’টোই ঘটে। যেমন এখন ঘটছে শীতের সঙ্গে বসন্তের। মাঝেমধ্যে সে দ্বন্দ্ব দেখতে উঁকিঝুঁকি মারছে মেঘলা আকাশ, মধ্যেমাঝে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিও।
ঋতুচক্র আসলে এ দেশের জোট-রাজনীতির মতো হয়ে গিয়েছে। সব মিলেমিশে খিচুড়িবৎ বলেই এককের চরিত্র বোঝা যাচ্ছে না। কবির নিদান— শীত এলে বসন্ত কি দূরে থাকে? ঋতু-ক্যালেন্ডারের হিসেবে দূরে থাকার কথাও নয়। কিন্তু কথা এ কালে আর কে রাখে! তাই শীতকাল কবে আসবে প্রশ্নে কবিমন উতলা হলেও ইদানীং উত্তর দিতে ইতস্তত করেন সুপর্ণা!
ঋতুচক্রের চরিত্রবদল সব গুলিয়ে দিয়েছে। এখন যেমন। পলাশ-শিমুল জানান দিচ্ছে, বসন্ত জাগ্রত। কিন্তু ভোররাতে শীতের আমেজ গায়ে চাদর টানতে বাধ্য করছে। দিনের বেলায় গরম। যদিও ক’দিন আগের মুখভার করা আকাশ আর বৃষ্টিতে তার উলটপুরাণ। আবহাওয়া দফতর নিম্নচাপের কথা উচ্চৈস্বরে জানায়। বিজ্ঞান মেনেই জানায়। জানায় উষ্ণায়নের ফলে ঘাবড়ে যাওয়া জলবায়ুর কথাও। তাই অসময়ে নেমে আসে জলনিবারক ছাতা। সোয়েটার-চাদর তোরঙ্গে ঢুকি-ঢুকি করেও না-ঢুকে লোকহিতের দায় পালন করে। যদিও দিকে দিকে নীল দিগন্তে ফুলের আগুন লাগে, বাজার জাগে আবিরের পসরায়। বোলপুর, পুরুলিয়া, ঘাটশিলার হোটেল আগাম বুকিংয়ে ভরে ওঠে।
তা হলে আদতে হচ্ছেটা কী! যোজন দূরত্বে চলে যাচ্ছে অভিযোজন। চাপমাত্রায় বাড়ছে-কমছে তাপমাত্রা। কখনও ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস সর্বোচ্চ আর সর্বনিম্ন ১৭ ডিগ্রি।
আর্দ্রতা আপন খেয়ালে সিঁড়ি উঠছে-নামছে। তৈলাক্ত বাঁশ আর বাঁদরের অঙ্কের মতোই। আর সেই সুযোগে অতিথি ভাইরাসেরা জাঁকিয়ে বসে তাথৈ-তাণ্ডব দেখাচ্ছে।
এ সবই তো প্রকৃতির সার্কাস। হাঁচি-কাশি-জ্বরের ট্র্যাপিজ। এর প্রভাবে মনের হাল কী মানুষের? নোয়াপাড়া মেট্রোস্টেশনের চারপাশে বেলা ১২টায় যখন মেঘাচ্ছন্ন অমরাবতী, তখন সাইকেল জমা রাখার দোকানি বলছেন, ‘‘মেঘলা ভালই লাগে। তবে শুকনো মেঘে লাভ নেই! দু’এক পশলা না দিলে দু’পয়সা বাড়াতে তো পারব না ভাড়া!’’ শীতের শেষে যত শীতপোশাক দোকানে জমা পড়ত, এ বার তা পড়েনি এখনও। তা নিয়ে মনখারাপ দক্ষিণ কলকাতার লন্ড্রি-মালিকের।
ঋতুর সঙ্গে নিকট সম্পর্ক কবির। কবি কী ভাবছেন? জয় গোস্বামী বলছেন, ‘‘আমাদের মনের সব অনুভূতির মতোই
ঋতুগুলোও অনেকাংশে মিলেমিশে থাকে একে অন্যের সঙ্গে। বইমেলার মাঠে যেমন সন্ধ্যায় শীত-শীত করে আর দুপুরে-বিকেলে বসন্তের হাওয়া টের পাওয়া যায়, ঠিক তেমনই। বসন্তে মিশে থাকে গ্রীষ্মের তাপও। এখন যেমন শীতের স্পর্শ লেগে বসন্তের গায়ে। আসলে, সব অনুভূতিই মিশ্র অনুভূতি।’’
একই অনুভূতি নিশ্চিত বিদ্যাপতিরও হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথেরও। বিদ্যাপতির ভরাবাদর তাই আশ্বিনের মাহ ভাদরে। তাতে ‘মনের মতো সুর বসাইয়া বর্ষার রাগিণী গাহিতে গাহিতে’ উদ্বেল হয় রবির বালক-মন। বড় হয়ে তাই তিনিই এক ঋতুর গান বাঁধেন অন্য ঋতুরাগে। তাতে কখনওই ঋতুসংহার ঘটে না। ‘আজি বরিষনমুখরিত’ বাজে পঞ্চমে। ‘সঘন গহন রাত্রি’ হয়ে ওঠে বাহার আর মল্লারের যৌথখামার। ‘বসন্ত তার গান’ রবীন্দ্রনাথে মাঝেমধ্যেই বসন্তরাগে লেখে না।
কাজেই, শেষ পর্যন্ত বসন্তেও কেন শীত আদেখপনা করছে, আকাশ মুখ ভার করছে, তা নিয়ে ভেবে খুব লাভ নেই বোধ হয়।