মেধাতালিকার প্রথম দশে এ বছর জায়গা করে নিয়েছে ১১৪ জন পরীক্ষার্থী। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
কেউ হতে চায় ডাক্তার, কেউ বা ইঞ্জিনিয়ার।
মাধ্যমিকের মেধাতালিকায় সেরা তিনে জায়গা করে নেওয়া ৬ জনই আধুনিক নানা পেশায় ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন সাজাচ্ছে। তবে পড়াশোনা আর পরীক্ষায় যে সাবেক অফলাইন-ব্যবস্থার কোনও বিকল্প নেই, তা সমস্বরেই মানছে কৃতীদের প্রত্যেকে।
অতিমারিতে তছনছ কৈশোর। দিনের পর দিন বন্ধ স্কুল। অনলাইন ক্লাস হলেও তাতে ষোলোআনা পড়াশোনার সুযোগ কই! সঙ্কটের এই পর্ব পেরিয়েই জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা উজ্জ্বল এই কৃতীদের। প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয়—তিনটি স্থানেই রয়েছে দু’জন করে পড়ুয়া। ৬৯৩ পেয়ে প্রথম হওয়া পূর্ব বর্ধমানের রৌণক মণ্ডল বর্ধমান শহরে থাকে। বিসি রোডের সিএমএস হাইস্কুলের এই ছাত্র পাঠ্যবইয়ের বাইরে একাধিক রেফারেন্স বইও পড়ত। লক্ষ্য চিকিৎসক হওয়া। রৌণক স্পষ্টই বলছে, ‘‘স্কুলে পড়াশোনা আর ক্লাসে বসে পরীক্ষা দেওয়ার মতো উপলব্ধি কিছুতে হয় না। বলতে পারেন, আমি অনলাইনের বিরুদ্ধে। শিক্ষকদের সামনে বসে তাঁদের কথা না শুনলে ঠিক মতো মূল্যায়ন হবে কী ভাবে? একই কথা প্রযোজ্য পরীক্ষাতেও। ক্রমাগত অনলাইনে পড়লে চোখেরও তো ক্ষতি হয়।’’ রৌণকের বাবা প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক কুন্তল মণ্ডল জানালেন, মোবাইলে বিশেষ আসক্তি নেই ছেলের।
যুগ্ম প্রথম বাঁকুড়ার গঙ্গাজলঘাটির রামহরিপুর রামকৃষ্ণ মিশনের অর্ণব গরাই। তারও মত, ‘‘অনলাইনের তুলনায় অফলাইনে পড়াশোনা এবং পরীক্ষা দেওয়া— দু’টোই বেশি সুবিধা। ক্লাসঘরে বসে পরীক্ষা দিলে একটা প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা তৈরি হয়। তা অনলাইনে হয় না।’’ সে আরও জানায়, অনলাইন পড়াশোনায় নেটওয়ার্ক মস্ত বাধা। আর ছাত্রজীবনে শিক্ষকদের সরাসরি সান্নিধ্য ভীষণ জরুরি। রাজ্যের নানা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা তো অনলাইন পরীক্ষা চেয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে? কৃতী এই ছাত্রের দৃঢ় জবাব, ‘‘অনলাইন পড়াশোনা কখনও ক্লাসে বসে পড়া বা পরীক্ষা দেওয়ার বিকল্প হতে পারে না।’’ রৌণকের মতোই ডাক্তার হতে চায় এই সেরাও।
দ্বিতীয় স্থানেও আর এক রৌনক মণ্ডল। সে ঘাটাল বিদ্যাসাগর হাইস্কুলের ছাত্র। মাধ্যমিকে ৬৯২ পাওয়া এই কৃতীর লক্ষ্য আইআইটিতে কম্পিউটার সায়েন্স পড়া। ফল ভাল হবে, নিশ্চিত ছিল সে। বিরাট কোহলির ভক্ত রৌনক বলছে, “শুধু চেয়েছিলাম, পরীক্ষাটা যেন অফলাইনে হয়। সেটা হয়েছে। সাফল্য পেয়েছি। এই মার্কশিটের মূল্যই আলাদা।” যুগ্ম দ্বিতীয় মালদহের গাজলের কৌশিকী সরকার অবশ্য এতটা ভাল ফল আশা করেনি। স্থানীয় আদর্শবাণী আকাদেমির এই ছাত্রীর বাবা-মা দু’জনেই শিক্ষক। পড়াশোনার ধরাবাঁধা সময় নেই কৌশিকীর। তবে সব সময় অফলাইন পরীক্ষাই চায় সে। তার মতে, অনলাইনে পরীক্ষা সকলের মেধার সমান বিচার করতে পারে না।
তৃতীয় স্থানে রয়েছে দুই কন্যাশ্রী। ফল ভাল হবে জানলেও তৃতীয় স্থান আশা করেনি পশ্চিম বর্ধমানের আসানসোলের উমারানি গড়াই মহিলা কল্যাণ স্কুলের ছাত্রী অনন্যা দাশগুপ্ত। রানিগঞ্জের গির্জাপাড়ার বাসিন্দা অনন্যার প্রাপ্ত নম্বর ৬৯১। সে বলছিল, “বেশি গুরুত্ব দিয়েছি ‘সেল্ফ স্টাডি’তে। তবে স্কুল খোলার পরে সরাসরি দিদিমণিদের কাছে পড়া বোঝা ও ব্ল্যাকবোর্ডের লেখা দেখে ভুল শুধরে নেওয়ার অভ্যাসটা খুব কাজে দিয়েছে। স্কুলে অনেক বার ‘মক টেস্ট’ হয়েছে। সব মিলিয়েই এই সাফল্য।” অনন্যার লক্ষ্য ইঞ্জিনিয়ার হওয়া।
যুগ্ম তৃতীয় পূর্ব মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম এগরার চোরপালিয়ার দেবশিখা প্রধান। চোরপালিয়া শ্রী শ্রী বাসন্তী বিদ্যাপীঠের এই ছাত্রী কিছুটা লাজুক। বাবা উৎপল এবং মা শম্পা প্রধান দু’জনেই স্নাতক। তবে কেউই সরকারি চাকরি পাননি। উৎপলের পেশা গৃহশিক্ষকতা। মেয়েকে টিউশনে পাঠানোর সামর্থ্য তাঁর ছিল না। তবে নিজে মেয়েকে পড়িয়েছেন। চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখা দেবশিখাও বলছে, ‘‘স্কুল খোলার পরে কী যে আনন্দ হয়েছিল। পরীক্ষাটাও অফলাইনে হওয়ায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচি।’’
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।