West Bengal Panchayat Election 2023

‘অপরাধের নিরাপদ করিডর’ ভোটেও হিংস্র থাকে বরাবর, সেই ডোমকলে আনন্দবাজার অনলাইন

হিংসা-সন্ত্রাসের ঘটনার জন্য যুগ যুগ ধরে শিরোনামে থেকেছে মুর্শিদাবাদের ডোমকল। ২০০৩, ২০০৮, ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটে শুধু এই ডোমকলেই রাজনৈতিক হানাহানিতে প্রাণ গিয়েছিল যথাক্রমে ৮, ১১, ১৮ জনের।

Advertisement

প্রণয় ঘোষ

ডোমকল শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০২৩ ১৮:৪০
Share:

নির্বাচনের সঙ্গে ডোমকলের রক্তস্রোতের সম্পর্ক নতুন নয়। হিংসা-সন্ত্রাসের ঘটনার জন্যই যুগ যুগ ধরে শিরোনামে থেকেছে মুর্শিদাবাদের এই মহকুমা। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

কেন জানি না, ভোট এলেই ডোমকলের জলহাওয়া বদলে যায়!

Advertisement

পড়ন্ত বিকেলে দোকানে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে এ কথা বলতে গিয়ে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন রফিক। ঘোর কাটতেই কিছু একটা বলতে গেলেন বটে, কিন্তু অস্ফুট স্বরে বলা কথাগুলো ঠিক বোধগম্য হল না। জোতকানাই শিশেপাড়া এলাকায় এই চায়ের দোকানটি ঠিক যে জায়গায়, তার থেকে কয়েকশো মিটার দূরেই দিন দশেক আগে গুলি চলেছে। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন চার জন। বছর চল্লিশের রফিক শেখ সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। এলাকা এখনও থমথমে। ভোটের সময় ডোমকলে আতঙ্ক উস্কে দিয়েছে ওই ঘটনা। কথায় কথায় রফিক বলেন, ‘‘পঞ্চায়েত ভোট মানেই ডোমকলে রক্ত!’’

জরাজীর্ণ বাড়ির দাওয়ায় বসে একই কথা বললেন বর্তনা গ্রামের বছর পঞ্চাশের সালামাতুল্লা শেখ। ১০ বছর আগে, ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটের ফলপ্রকাশের পরের দিনই পিটিয়ে খুন করা হয়েছিল তাঁর ভাইপো সরিকুল ইসলামকে। বাঁশ, লোহার রড, শাবলের ঘায়ে থেঁতলে গিয়েছিল তাঁর গোটা শরীর। সেই দিনের ঘটনার কথা বলতে গিয়ে সালামতুল্লার চোখ থেকে জল গড়াতে শুরু করেছে। প্রৌঢ় বললেন, ‘‘মাঠ থেকে সবে বাড়ি ফিরেছি, হঠাৎ শুনি হইচই। ঘর থেকে গামছাটা নিয়ে বেরোতে যাব, তখনই বাইরে মুড়ি-মুড়কির মতো বোমা পড়তে শুরু করল। কিছু ক্ষণ পরেই এলোপাথাড়ি গুলি। ঘণ্টাখানেক ধরে এ সব চলেছিল। একটু শান্ত হলে চায়ের দোকানে ছুটে গিয়ে দেখি, ভাইপোটা রাস্তায় পড়ে রয়েছে। সেই সময় আবার বোমাবাজি। কিচ্ছু করতে পারিনি। রাস্তাতেই মারা গেল ছেলেটা!’’ নিহত সরিকুলের বাবা শাজাহানের আক্ষেপ, সেই দিন যাঁরা সরিকুলকে খুন করেছিলেন, তাঁরাই আজ তাঁদের নেতা! বৃদ্ধ বলেন, ‘‘জীবন দিয়ে বুথ আগলে সেই দিন দলকে জিতিয়েছিলাম। যে আমার ছেলের প্রাণ কাড়ল, সে আজ আমার নেতা হয়ে গিয়েছে! কাকে ভোট দেব? কেন ভোট দেব? আমরা আর কাউকে ভোট দিই না!’’

Advertisement

নির্বাচনের সঙ্গে ডোমকলের রক্তস্রোতের সম্পর্ক নতুন নয়। হিংসা-সন্ত্রাসের ঘটনার জন্যই যুগ যুগ ধরে শিরোনামে থেকেছে মুর্শিদাবাদের এই মহকুমা। ২০০৩, ২০০৮, ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটে শুধু এই ডোমকলেই রাজনৈতিক হানাহানিতে প্রাণ গিয়েছিল যথাক্রমে ৮, ১১, ১৮ জনের। এ বারের ভোটে বড় ঘটনা বলতে অবশ্য শিশেপাড়ার গুলিকাণ্ডই। গত ২৬ জুন শাসক তৃণমূল এবং সিপিএমের মধ্যে সংঘর্ষের জেরে ওই ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু কারও প্রাণহানি হয়নি। কিন্তু ডোমকলের জলহাওয়া যাঁরা চেনেন, তাঁদের অনেকেই আতঙ্কিত এ বারের ভোট নিয়ে। পুরাতন বিডিও অফিস মোড়ের ব্যবসায়ী তৌসিফ ইকবাল হাতের তেলোর মতো ডোমকলকে চেনেন। তাঁর কথায়, ‘‘এ বছরের মতো গুমোট ভাব কোনও ভোটে দেখিনি। সত্যিই বেশি ভয় লাগছে এ বার!’’

গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

আতঙ্কিত রমনার বাসিন্দা বিলকিস বিবিও। বললেন, ‘‘দু’দিন আগেই রাতে বাড়িতে এসে শাসিয়ে গিয়েছে, ভোটের দিন যেন বাইরে না বেরোই। এই ঘটনা তো আর নতুন নয়। প্রতি বারই ঘটে। গত বারেই আমরা বাড়ির তিন বৌ আর শাশুড়ি মিলে ভোট দিতে যাচ্ছিলাম। রাস্তার মোড়েই আমাদের ভোটার কার্ড কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। বন্দুক দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, আমরা কাদের ভোট দেব! ছুটে বাড়ি চলে এসেছিলাম সে বার। এ বার পরিস্থিতি বুঝে ভোট দিতে যাব।’’

বরাবরই জেলার রাজনৈতিক স্রোতের বিপরীতে অবস্থান করে ডোমকল। সেই রাজনীতির সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁদের দাবি, বিরোধী গোষ্ঠী মাথা তুলে দাঁড়ালেই অশান্তি ছড়ায় এখানে। গত পঞ্চায়েত ভোটে বিরোধীদের মনোনয়ন দিতে না দেওয়ায় এক নতুন ইতিহাস গড়েছিল ডোমকল। তবে এ বার বিরোধীদের বজ্রনির্ঘোষ, আর ‘ওয়াকওভার’ হচ্ছে না! এ বার কোমর বেঁধেই মাঠে নেমেছে ডোমকলের বিরোধীরা। স্থানীয়দের একাংশ বলছেন, এ বারের পঞ্চায়েত ভোটে ডোমকল ও রানিনগরে জোটের উত্থান চোখে পড়ার মতো। পুরনো বাম ও কংগ্রেস কর্মীদের পাশাপাশি শাসক দলের ‘বিক্ষুব্ধ’ অংশ ভিড়েছেন বিরোধী শিবিরে। যার জেরে এ বার শাসক-বিরোধী দু’পক্ষেরই পাল্লা ভারী। তার প্রমাণ, ভোটঘোষণার পর থেকে এলাকায় যত হিংসার ঘটনা ঘটেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাম-কংগ্রেস অভিযুক্ত।

সিপিএমের ডোমকল এরিয়া কমিটির সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান অবশ্য বলছেন, ‘‘তৃণমূল গণতন্ত্রের গলা টিপে মারছে। মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে প্রতিরোধে এগিয়ে এসেছেন। যদি ভোট দিতে বাধা দেওয়া হয়, একই ভাবে প্রতিরোধ করবেন মানুষ।’’ তাঁর দাবি, সেই প্রতিরোধ ভাঙতে শাসক দল বোমা-বন্দুক ব্যবহার করতে পারে। রানিনগর-২ ব্লকের স্থানীয় কংগ্রেস নেতা জাহাঙ্গির ফকিরও বললেন, ‘‘এটা ২০১৮ নয়, ২০২৩! এ বার মানুষ ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। যারা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করবে, তারা যেন নিজের দায়িত্বে বুথে আসে।’’ ডোমকলের তৃণমূল বিধায়ক জাফিকুল ইসলামের পাল্টা বক্তব্য, ‘‘প্রতিরোধের নামে বিরোধীরাই মানুষের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে। পুলিশ-প্রশাসনের কাছে আবেদন, দল বা রং না-দেখে উদ্ধার করা হোক আগ্নেয়াস্ত্র, বোমা। রক্তপাতহীন নির্বাচন চাই ডোমকলে।’’ বিরোধীদের ‘প্রতিরোধের’ এই ঘোষণাতেই সন্ত্রস্ত এলাকার বাসিন্দারা। পঞ্চাশোর্ধ্ব জার্মান মণ্ডল বলেন, ‘‘২০১৮ সালের শেষ পঞ্চায়েত ভোটে বিরোধীরা মনোনয়নই দিতে পারেনি। কিন্তু এ বার বিরোধীরা প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন। তাতেই আবার ডোমকল অশান্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।’’

ডোমকলে মোতায়েন কেন্দ্রীয় বাহিনী। নিজস্ব চিত্র।

ডোমকলে ভোটের ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে এই আশঙ্কার উত্তর মেলে। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোট। রাজ্যের ক্ষমতায় বামেরা। কিন্তু মুর্শিদাবাদে প্রায় নিধিরাম সর্দারের মতো অবস্থা তাদের। অধীর চৌধুরীর কংগ্রেস তখন রীতিমতো বাম দুর্গে থাবা বসিয়েছে। ডোমকল তখন বারুদের স্তূপ। নির্বাচনের দিন এখানেই রাজনৈতিক হানাহানিতে খুন হয়েছিলেন দু’পক্ষের ১৩ জন। স্থানীয়দের একাংশের দাবি, খাতায়কলমে ১৩ জন হলেও, ভোটের আগের দিন এমনকি ভোটের পরেও বেশ কিছু লাশ সকলের অগোচরেই কবর দেওয়া হয়েছিল। ডোমকলের তৎকালীন এক পুলিশ আধিকারিক বলেন, ‘‘এ ছাড়া আর কী বা করার ছিল আমাদের বলুন? ঘাড়ে করে একের পর এক লাশ বয়েছি। এখনও রাতে ঘুমোতে গিয়ে সে দিনের কথা মনে পড়লে চমকে উঠি। উপরতলার কর্তাদের চাপ ছিল, মৃতদেহের সংখ্যা যেন আর না বাড়ে! কিন্তু ডোমকল থামছে না, সকাল থেকে শুরু হয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত নাগাড়ে খবর আসছিল আমাদের কাছে। শেষ পর্যন্ত বেশ কিছু পরিবার চুপচাপ মৃতদেহ মাটি দিয়ে দিচ্ছে দেখেও, না দেখার ভান করেছিলাম।’’

বাম আমলে ডোমকলে বোমা-গুলির লড়াই হত সিপিএম এবং কংগ্রেসের মধ্যে। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে ২০১৩-র ভোটেও মৃত্যু হয়েছিল ১৮ জনের। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনের আগে পর্যন্ত ডোমকলে রাজপাট ছিল সিপিএম ও কংগ্রেসের। বিধায়ক, সাংসদ থেকে স্থানীয় পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদ সবই ছিল তাদের দখলে। তত দিনেও ডোমকলের মাটিতে দাঁত ফোটাতে পারেনি রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে লড়াই জমে উঠলেও প্রয়াত মান্নান হোসেনের ছেলে সৌমিক হোসেনকে হারিয়ে শেষ হাসি হাসেন সিপিএমের আনিসুর রহমান। ‘হাওয়া’ ঘুরতে শুরু করে এর পরেই। বিরোধীদের টিকিটে জয়ী প্রার্থীরা দলে দলে যোগ দিতে শুরু করেন তৃণমূলে। ডোমকলের প্রথম পুরভোটে সব ক’টি আসন দখল করে তৃণমূল। বিরোধীদের অভিযোগ, ভোটের নামে সেটা ছিল নিছক প্রহসন।

মুর্শিদাবাদের স্পর্শকাতর কেন্দ্রগুলির তালিকায় বরাবরই থাকে ডোমকল। কিন্তু ব্যতিক্রম ঘটে ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে। যে নির্বাচনকে রাজ্য-রাজনীতির ইতিহাসের একটা ‘কালো অধ্যায়’ বলে চিহ্নিত করে থাকেন বিরোধীরা, যে ভোট ঘিরে হিংসার নিন্দায় দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত মুখ খুলেছেন, সেই ভোটে আশ্চর্য এক শান্তি ছিল ডোমকলে! শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীরা একে ‘উন্নয়নের শান্তি’ বললেও, বিরোধী নেতারা কটাক্ষ করে বলেন, ‘শ্মশানের শান্তি!’ কিন্তু কোন জাদুতে সে বার হিংসামুক্তি ঘটিয়ে ফেলেছিল ডোমকল? উত্তর সহজ। ভোটটাই তুলে দেওয়া হয়েছিল! ডোমকল মহকুমার ১০টি জেলা পরিষদ আসনই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে নিয়েছিল শাসক তৃণমূল। বিরোধী নেই, লড়াই নেই, প্রাণহানিও নেই!

২০১৪ সালের লোকসভা ভোটেও নিস্তরঙ্গই ছিল ডোমকল। নির্বাচনের আগে তেমন অশান্তি হয়নি। ভোট মিটেছিলও বড় কোনও গন্ডগোল ছাড়া। সে বার অবশ্য প্রেক্ষাপট ভিন্ন ছিল। কেউ কেউ বলেন, লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলই নাকি ‘উদাসীন’ করেছিল ডোমকলকে! জেতা আসন মুর্শিদাবাদ হারিয়ে কার্যত মুষড়ে পড়েছিল কংগ্রেস। রাজ্য জুড়ে জয়জয়কার হলেও মুর্শিদাবাদে তৃতীয় স্থানে শাসক তৃণমূল। অন্য দিকে, জিতেও সিপিএম ছিল রাজ্য তথা দেশ জুড়ে বামফ্রন্টের সার্বিক বিপর্যয়ে হতাশ। সব মিলিয়ে কোনও রাজনৈতিক দলেরই উচ্ছ্বাস ছিল না। ছিল না বিজয় মিছিল, বাজি ফাটানো বা এই সব ঘিরে গন্ডগোল।

ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য সমাজবিরোধীদের কাছে পছন্দের আস্তানা হয়ে উঠেছে ডোমকল, মত জেলা পুলিশ আধিকারিকদের একাংশের। নিজস্ব চিত্র।

কিন্তু ডোমকলের এমন চেহারা তো সব বার থাকে না! ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে রাজ্যে এক জনই খুন হয়েছিলেন। এই ডোমকলেই। বুথের কাছে সিপিএম প্রার্থী আনিসুরের এজেন্ট তহিদুল ইসলামকে খুন করার অভিযোগ উঠেছিল তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে। এ বার পঞ্চায়েত ভোটে দামামা বাজার পর থেকেই ভিতরে ভিতরে অস্থির তহিদুলের স্ত্রী মুর্শিদা বেওয়া। হরিডোবা গ্রামের বাড়ির নিকোনো দাওয়ায় বসে মাঝেমধ্যেই শিউরে উঠে মুর্শিদা বলছেন, ‘‘আবার ভোট, আবার অশান্তি, আবার রক্ত, আবার লাশ!’’ ভোটের দিন একটা বাসি রুটি খেয়ে স্ত্রীকে নিয়ে ভোর-ভোর বুথের দিকে রওনা দিয়েছিলেন তহিদুল। মুর্শিদা খাবার তৈরির কথা বললেও তিনি বলেছিলেন, ‘‘না, খাবার নয়, ভোট আগে। তৃণমূল গন্ডগোল পাকাতে পারে, তাই সকাল-সকাল ভোট দিতে হবে।’’ সকাল সকাল বিনা বিপত্তিতে ভোট দেওয়া হয়ে গিয়েছিল মুর্শিদার। হাঁফ ছেড়ে স্ত্রীকে এগিয়ে দিতে বাইরে এসেছিলেন তহিদুল। এমন সময়েই হামলা। সেই দিনের ঘটনার কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন মুর্শিদা। কেঁদে-কেঁদে আর কথা বেরোচ্ছিল না তাঁর গলা দিয়ে। ধীরে ধীরে মুর্শিদা বলতে থাকেন, ‘‘একসঙ্গে বেরিয়েই দেখি, ওরা পাশ থেকে বোমা ছুড়ছে। একটা বোমা কাছে এসে পড়তেই লুটিয়ে পড়ল ও (তহিদুল)। আমি হাতটা ধরতেই আরও একটা বোমা। ছিটকে যাই। খুনিরা ওকে কুপিয়ে চলে যাওয়ার আগে চেনা লোকেরাও কেউ কাছে ঘেঁষতে পারছিল না। পরে ওরাই কাঁধে করে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিছুটা যেতেই ও মারা যায়।’’

ভোট আসতেই সেই আতঙ্কটা আবার চেপে বসছে মুর্শিদার মনে। তাঁর কথায়, ‘‘বার বার সেই সকালের ছবিটা ভেসে উঠছে। সেই চেনা মুখগুলো পিস্তল নাচাতে নাচাতে আসছে আর বলছে, কোনও দরকার নেই। বুথমুখো হলেই আবার ছবি করে দেব! খোলা গলায় বলছে, পুলিশ, কোর্ট, টিভির লোক— কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না। ছেলেমেয়েরা বাড়ির বাইরে। আমি স্বামীর ভিটেটা আঁকড়ে পড়ে আছি। ওরা কবে আমাকে স্বামীর পাশে কবরে পাঠাবে, তার অপেক্ষায় বসে আছি। আল্লাহ ছাড়া আর আমাদের কেউ নেই, তার কাছেই বিচার চেয়েছি, শেষ বিচার!’’

স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, ভোট আসতেই এলাকায় আবার ‘বহিরাগতদের’ আনাগোনা বেড়ে গিয়েছে। শুরু হয়ে গিয়েছে বোমা, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে তাঁদের দাপিয়ে বেড়ানো! ভোট-রাজনীতির পরিভাষায় যাকে বলে ‘এরিয়া ডমিনেশন’। পুলিশ সূত্রে খবর, ডোমকলের কুচিয়ামোড়া, সারাংপুরের মতো এলাকা সমাজবিরোধীদের গোপন আস্তানা বলেই পরিচিত। এক পুলিশকর্মী বলছেন, ‘‘ডোমকলে ভোট মানেই বুক কেঁপে ওঠা। মনোনয়ন পর্বের আগে থেকেই গভীর রাতে আমাদের কাছে চাপা গলার অনেক ফোন আসতে শুরু করেছে। কেউ ফোন করে বলেন, নদীর ও পারে লোক জড়ো হয়েছে, আবার কোথাও মাঠে বোমা বাঁধা চলছে বলে খবর আসছে। এককালে ভোটের সময় এতই বোম পড়ত যে, ডোমকলের নাম বোমকল দেওয়া হয়েছিল!’’

কুচিয়ামোড়া ডোমকলে বোমা তৈরির আঁতুড়ঘর বলেই পরিচিত। এই বর্ধিষ্ণু গ্রামের ভোট-সন্ত্রাসের ‘ঐতিহ্য’ও বহু দিনের। নব্বইয়ের দশকে কুচিয়ামোড়ার খুনের ঘটনার কথা বলতে গিয়ে আজও থমকে যেতে হয় জেলা পুলিশ আধিকারিকদের। এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘এক সময়ে খুনের পরে কাটা মুন্ডু নিয়ে ফুটবল খেলা, রক্ত নিয়ে হোলি খেলা হত কুচিয়ামোড়ায়। টানা দশ বছর চলেছিল সে সব।’’ সেই সময়ে কুচিয়ামোড়ার অনেক পরিবারই নিজেদের ঠিকানা বদলে ফেলেছিল। কেউ গড়াইমারি বা কাটাকোপরা, কেউ আবার ডোমকল বা বহরমপুরে পাকাপাকি ভাবে শুরু করেন বসবাস করতে। তাদের ফেলে আসা সেই সব দালান বাড়িতে জন্মেছে আগাছা। পেরেক ঠোকা সেই উঁচু কাঠের দরজায় এখন ঘুণ ধরেছে। গ্রামের প্রান্তিক চাষিও এখন কুচিয়ামোড়া গ্রামে বাস করতে রাজি নন। কুচিয়ামোড়ার বাসিন্দা তৈমুর ইমাম হাসানের দাবি, ‘‘আগের মতো আর খুন না হলেও দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য তো রয়েইছে। আমাদের রাতে ঘুম হচ্ছে না। আতঙ্ক গোটা গ্রামকে গ্রাস করেছে। ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে পারে না, গৃহশিক্ষকের দেখা নেই! প্রাণ খুলে যে গ্রামের রাস্তায় একটু ঘুরব, সে পরিবেশও নেই। মাথা গোঁজার মতো একটু জায়গা কিনতে পারলেই গ্রাম ছাড়ব। ভোটের সময় এই সব বাইরের লোকেদের উৎপাতে আর টেকা যাচ্ছে না!’’

জেলা পুলিশ আধিকারিকদের একাংশের মত, ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য সমাজবিরোধীদের কাছে পছন্দের আস্তানা হয়ে উঠেছে ডোমকল। এই এলাকার উত্তরে নদিয়ার করিমপুর। পূর্বে বাংলাদেশ সীমান্ত। এক পুলিশ কর্তা বলেন, ‘‘কোনও অপরাধ ঘটিয়ে নদী পেরোতে পারলে সহজেই পুলিশের চোখ এড়ানো যায়। আবার ভিন্‌জেলার দুষ্কৃতীরা নদী পেরিয়ে ডোমকলে ঢুকে যে কোনও রকম নাশকতা ঘটিয়ে সহজেই নদিয়ায় ফিরে যেতে পারে। আবার সীমান্তে কাঁটাতারবিহীন এলাকা দিয়েও জলপথে সহজেই ডোমকলে ঢুকে যাওয়া যায়। বাংলাদেশ টু ডোমকল ভায়া জলঙ্গি— বরাবরই অপরাধীদের নিরাপদ করিডর বলে পরিচিত।’’

বিরোধীদের দাবি, সমাজবিরোধীরা সকলেই তৃণমূল আশ্রিত! প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেন, ‘‘তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা ডোমকলে রীতিমতো অস্ত্র তৈরির গবেষণাগার গড়ে তুলেছে। ভোটের দিন সেগুলো বার করবে। এলাকার সমাজবিরোধীরা সকলেই তৃণমূলের।’’ বিজেপির মুর্শিদাবাদ দক্ষিণের সভাপতি শাখারভ সরকারও বলেন, ‘‘প্রতি বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী না থাকলে ডোমকলই এ বার হিংসার সব রেকর্ড ভেঙে দেবে। প্রশাসন সক্রিয় না হলে ভোটের দিন যে কত লাশ গুনতে হবে, তা ভেবেই চিন্তিত আমরা।’’ পাল্টা বহরমপুর-মুর্শিদাবাদ সাংগঠনিক জেলা তৃণমূল সভানেত্রী শাওনি সিংহ রায় বলেন, ‘‘সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করে বাম-কংগ্রেস পঞ্চায়েতে দখল করতে চাইছে। ডোমকলে আমাদের চার জন কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। ৩০ জনের বেশি আক্রান্ত। তা হলেই বুঝুন, ডোমকলের সমাজবিরোধীরা এখন কাদের সম্পদ!’’

পুলিশ সূত্রে অবশ্য খবর, অতীতের ঘটনা নজরে রেখে এ বার ডোমকলে বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কোথায় কোথায় অশান্তি হতে পারে, গোপন সূত্র মারফত খবরের ভিত্তিতে সেই জায়গাগুলিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে— ডোমকল ব্লকের ঘোড়ামারা গ্রাম পঞ্চায়েতের নিশ্চিন্তপুর, সারাংপুর গ্রাম পঞ্চায়েত, ধুলাউড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের তুলসিপুর, জুরানপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের কুশিবেড়িয়া, রানিনগর ব্লকের ডেপুটিপাড়া, চক রামপ্রসাদ এবং চাকরাংপাড়া এলাকা।

মুর্শিদাবাদ পুলিশ জেলার সুপার সুরিন্দর সিংহ বলেন, ‘‘জেলার সর্বত্র অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোটের জন্য সব রকম ব্যবস্থা নিচ্ছে জেলা পুলিশ। এ বার ডোমকলের দিকে বাড়তি নজর দেওয়া হচ্ছে। মনোনয়ন থেকে শুরু করে প্রচার পর্ব পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা কড়া হাতে সামলানো হয়েছে। গোপন সূত্রদের সক্রিয় করে বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারের ব্যাপারেও বাড়তি নজর দিয়েছে থানাগুলি। বিভিন্ন এলাকায় প্রচারও চালানো হচ্ছে। শান্তিপূর্ণ ভোট সম্পন্ন করতে জেলা পুলিশ বদ্ধপরিকর।’’

পুলিশি আশ্বাসে অবশ্য চিড়ে ভিজছে না! কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট হলেও ডোমকলে অশান্তি কতটা রোখা যাবে, তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। সারাংপুরের ফারুক শেখ বলছেন, ‘‘সব বদলাচ্ছে, কিন্তু এ জন্মে আর ডোমকলের হিংস্র স্বভাবের বদল দেখে যেতে পারব বলে মনে হয় না!’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement