ন্যায্য দাম পেলে এখনই জমি দিতে চান অনেকে

এক পক্ষ বলছেন, আর পারছি না। ঠিকমতো দাম পেলে এখনই জমি দিয়ে দেব। অন্য পক্ষ তাকিয়ে ‘উপরওয়ালা’র দিকে। তিন বছর লাগাতার আন্দোলন এবং তার পরে ছ’বছর ধরে অপেক্ষা করেও জমি ফিরে পাননি সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’রা। দিন দিন তাঁদের অবস্থা খারাপ হচ্ছে।

Advertisement

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

সিঙ্গুর শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০১৪ ০৩:৪০
Share:

এক পক্ষ বলছেন, আর পারছি না। ঠিকমতো দাম পেলে এখনই জমি দিয়ে দেব।

Advertisement

অন্য পক্ষ তাকিয়ে ‘উপরওয়ালা’র দিকে।

তিন বছর লাগাতার আন্দোলন এবং তার পরে ছ’বছর ধরে অপেক্ষা করেও জমি ফিরে পাননি সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’রা। দিন দিন তাঁদের অবস্থা খারাপ হচ্ছে। কেউ দিনমজুরি করছেন। কেউ বা রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে। জমি ফিরে পাওয়ার আশা করেন না অধিকাংশ চাষিই। আস্থাও হারিয়ে ফেলছেন সকলের উপর থেকে। এই নিয়ে প্রশ্ন উঠলে এক জন আকাশের দিকে আঙুল তুলে বোঝাতে চাইছেন, ভগবান ছাড়া আর কাউকে ভরসা করেন না। অন্য দল বলছেন, বরং শিল্প ফিরে আসুক। ন্যায্য দাম পেলে তাঁরা আর আপত্তি তুলবেন না।

Advertisement

বুধবার কলকাতায় বণিকসভার একটি অনুষ্ঠানে এসে টাটা গোষ্ঠীর প্রাক্তন কর্ণধার এবং বর্তমান এমেরিটাস চেয়ারম্যান রতন টাটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, সিঙ্গুর-ক্ষত তাঁর এখনও শুকোয়নি। ‘অনিচ্ছুক’ চাষিদের জমি ফেরানোর দাবিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জঙ্গি আন্দোলনের জেরে ২০০৮-র ৩ অক্টোবর, দুর্গাপুজোর ষষ্ঠীর দিন সিঙ্গুর থেকে গুজরাতে ন্যানো কারখানা নিয়ে যাওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন তিনি।

বছর আটেক আগে তৎকালীন রাজ্য সরকার এই জমি অধিগ্রহণ করে টাটাকে দিয়েছিল ন্যানো কারখানার জন্য। অধিগ্রহণে আপত্তি ছিল যাঁদের, সেই চাষিরা তখন রাস্তায় নেমেছিলেন প্রতিবাদ আন্দোলনে। এই জমি আন্দোলনকে হাতিয়ার করে ২০১১-তে রাজ্যে ক্ষমতায় আসেন মমতা। শপথের পরে তাঁর প্রথম সিদ্ধান্ত ছিল সিঙ্গুর জমি আইন করে ‘অনিচ্ছুক’দের জমি ফেরানো।

তার পরেও তিন বছর পেরিয়ে গিয়েছে, কিন্তু সিঙ্গুর রয়েছে সেই তিমিরেই। রাজ্যের তৈরি আইন আপাতত সুপ্রিম কোর্টে। সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন সেই মামলার পরিণতি কী হবে, কেউ জানেন না। জমি ফেরত পেলেও তা চাষযোগ্য থাকবে কি না, রয়েছে সে প্রশ্নও।

তাই বৃহস্পতিবার পড়ন্ত বিকেলে গোপালনগরের সানাপাড়ার ‘অনিচ্ছুক’, সত্তর ছুঁই ছুঁই মীরা পাঁজা বলেই দিলেন, “যা হওয়ার নেতাদের ছেলেদের বা নেতাদের পিছু পিছু যারা ঘুরছে, তাদের ছেলেদের হবে। আমার ছেলেকে চাষই করতে হবে। ওর চাকরি হবে না। আমাদের জন্য কেউ নেই। একমাত্র উপরওয়ালা আছে।”


(বাঁ দিকে) জমি হারানো অনিচ্ছুক চাষি প্রভাত শী। (মাঝখানে) জমি আন্দোলনে অগ্রণী

ভূমিকা নিয়েছিলেন মীনা পাঁজা। (ডান দিকে) আর এক জমিহারা অনিচ্ছুক চাষি শিবরাম ধাওয়া।— নিজস্ব চিত্র।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আর এক চাষির কথায়, “এক সময়ে আদালতের বাইরে মধ্যস্থতার মাধ্যমে জমি নিয়ে যাবতীয় জটিলতা মিটিয়ে নেওয়ার কথা উঠেছিল। তা-ও তো মানা হল না। কার উপরে আর ভরসা করব? যা করার ঈশ্বরই করবেন।”

বুধবার সকালে সিঙ্গুরের মেঘলা আকাশে হেলিকপ্টার চক্কর কাটতে দেখেছেন গ্রামবাসীরা। পরে টিভিতে রতন টাটার খবর জানতে পেরে তাঁরা ধরে নেন ওই কপ্টারে তিনিই ছিলেন। তাই বৃহস্পতিবার এ নিয়ে প্রশ্ন করতেই কয়েক জন চেঁচিয়ে ওঠেন, “উনি কলকাতায় এসেছেন। অনেক কথা বলেছেন। তা শুনে আপনারা সিঙ্গুরে চলে এলেন। কই এত দিন তো কোনও খোঁজখবর করেননি!”

সিঙ্গুরের ক্ষোভ প্রশমনে ২ টাকা কেজি দরে মাসে ১৬ কেজি চাল এবং দু’হাজার টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে রাজ্য। কিন্তু সেই সামান্য কতটুকুই বা হয় বলছেন চাষিদের অনেকেই। তাই তাঁদের কেউ কেউ চান, এ বার শিল্প হোক। যেমন, প্রভাত শী। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের পাশে টাটাদের প্রকল্প এলাকার ধারেই থাকেন। জমি-আন্দোলনে থাকা ওই বৃদ্ধ বলেই দিলেন, “সেই সময়ে একটু কথা বলে বেশি টাকা দিলে তো জমি দিতাম। এখনও ঠিক দাম পেলে জমি দিয়ে দেব। আর ভাল লাগছে না।” কেউ কেউ নিজেরাই দাম বেঁধে দিচ্ছেন। যেমন, শিবরাম ধাওয়া। টাটাদের প্রকল্পের আওতায় তাঁর পাঁচ বিঘা জমি গিয়েছে। শিবরামবাবু এখন বলছেন, “সামান্য জমি রয়েছে। সেখানেই চাষাবাদ করছি। এখন কাঠাপ্রতি ৫০ হাজার টাকা দিলেই জমি দিয়ে দেব। ওখানে টাটারা কারখানা করুক বা অন্য কেউ, কিছু একটা হোক।”

এমন স্বর শোনা যাচ্ছে আরও। তা নিয়ে সিঙ্গুরের তৃণমূল বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বেশি ভাবিত নন। তাঁর কথায়, “অনিচ্ছুক চাষিরা কেউ কেউ এত দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করছেন, হতাশা আসতে পারে। আমরা কোর্টের রায়ের দিকেই তাকিয়ে।”

পুজো দোরগোড়ায়। শুভ-সংবাদের অপেক্ষা করতে করতে ছ’বছর পার করেছেন ‘অনিচ্ছুক’রা। এই অপেক্ষা আরও কত দীর্ঘ হবে, সেটাই এখন তাঁদের প্রশ্ন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement