এ ভাবেই জেল চত্বরের দখল নিয়ে নিয়েছিল বন্দিরা। —নিজস্ব চিত্র।
বিভিন্ন বয়সের কয়েকশো মানুষ প্রায় উন্মত্তের মতো ছুটে বেড়াচ্ছেন গোটা মাঠ জুড়ে। কারও হাতে বাঁশের লাঠি, উইকেট, লোহা বা স্টিলের রড। কারও হাতে আবার ধারালো বঁটি! একটু দূরে বিশাল বাড়িটা থেকে সার্চ লাইট এসে পড়ছে মাঠে। টানা বেজে চলেছে পাগলাঘণ্টি! সোমবার সন্ধ্যায় বারুইপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের দৃশ্যটা ছিল এমনই।
ঘণ্টা চারেক ধরে গোটা সংশোধনাগার চত্বর কার্যত বন্দিদের দখলে চলে যায়। সশস্ত্র বন্দিদের ওই রকম মারমুখী দেখে প্রথম দিকে রীতিমতো পিঠটান দেন কারা আধিকারিক এবং রক্ষীরা। পরে কারারক্ষী এবং বারুইপুর পুলিশের বিশাল বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র বন্দিদের দফায় দফায় সংঘর্য চলে। বন্দিরা ইট ছুড়তে থাকে। পাল্টা ব্যাপক লাঠি চার্জ করে পুলিশ এবং কারারক্ষীরা। কয়েক জন প্রত্যক্ষদর্শীর দাবি, কাঁদানে গ্যাসও ব্যবহার করা হয়। যদিও পুলিশ বা কারা দফতর সেই অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছে।
প্রায় চার ঘণ্টার চেষ্টায় বিদ্রোহী বন্দিদের নিজের নিজের ওয়ার্ডে ঢুকিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া গেলেও মঙ্গলবারও বিক্ষোভ চলছে বারুইপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে। সোমবার রাতে বন্দিদের বিক্ষোভের ছবি রীতিমতো ভিডিয়ো আকারে সংশোধনাগারের চার দেওয়ালের বাইরে চলে এসেছে। যেখানে কারা দফতরের ছোট-বড়-মেজো সব পর্যায়ের আধিকারিকদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিতে দেখা গিয়েছে বন্দিদের। যদিও সেই ভিডিয়োর সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার।সেখানে বন্দিরা দাবি করেছেন, নিজেদের অভাব-অভিযোগ তাঁরা জানাতে চান খোদ মুখ্যমন্ত্রীকে। একান্তই যদি তা সম্ভব না হয়, সে ক্ষেত্রে নিজেদের অভিযোগের কথা তাঁরা কারামন্ত্রীকে জানানোর দাবি করেন। কারা দফতরের শীর্ষ সমস্ত আধিকারিক পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হলে খোদ কারামন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাস নিজে সোমবার রাতে যান বারুইপুর সংশোধনাগারে।
আরও পড়ুন: দিল্লিতে পুলিশের দিকে পিস্তল তাক করা সেই যুবক গ্রেফতার
এ বিষয়ে মঙ্গলবার কারামন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘রাত প্রায় দেড়টা অবধি আমি বারুইপুরে ছিলাম। শুনেছি এ রকম কিছু ভিডিয়োর কথা। আমি গোটা বিষয় নিয়ে রিপোর্ট দিতে বলেছি। রিপোর্ট পাওয়ার পর দেখব, দফতরের কর্মীদের কী ভূমিকা।” মন্ত্রী জানান, ওই মারমুখী বন্দিরা বারুইপুর সংশোধনাগারে যে আধুনিক রান্নাঘর এবং খাওয়ার জায়গা তৈরি করা হয়েছিল তা ভাঙচুর করে তছনছ করেছে। সেই সঙ্গে বিচারাধীন বন্দিদের জন্য সরাসরি আদালতে হাজির না হয়েও ভিডিয়ো কনফারেন্সের মাধ্যমে যে শুনানির ব্যবস্থা ছিল তা-ও ভাঙা হয়েছে। উজ্জ্বলের প্রশ্ন, ‘‘ওই ব্যবস্থাগুলি করা হয়েছিল বন্দিদের ভাল ভাবে রাখার জন্য। যাঁরা সেগুলো নষ্ট করেছেন তাঁরা তা হলে ভাল ব্যবস্থা চান না।”
সোমবার বিকেলে নিয়মমাফিক বন্দিদের মাথা গুনতির সময় থেকেই শুরু হয় বিক্ষোভ। প্রাথমিক ভাবে কারা কর্মীদের একাংশ দাবি করেছিলেন, সাজাপ্রাপ্ত এবং বিচারাধীন বন্দিদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। পরে যখন গোটা সংশোধনাগার চত্বর বন্দিদের দখলে চলে যায়, তখন কারা দফতরের কর্মীদের একটি অংশ দাবি করেছিলেন, বন্দিদের ওয়ার্ডে থাকা বেআইনি মোবাইল তল্লাশি এবং বাজেয়াপ্ত করাকে কেন্দ্র করেই গন্ডগোলের সূত্রপাত।
মঙ্গলবার জেলকর্মীদের একটি অংশ জানিয়েছেন, এই গন্ডগোলের পিছনে রয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুখ্যাত দুষ্কৃতী পোড়া স্বপন এবং তার দলবল। জেলকর্মীরা জানিয়েছেন, পকসো আইনে বিচারাধীনদের ভিডিয়ো কনফারেন্সের মাধ্যমে শুনানি হচ্ছে। ফলে তারা জেলের বাইরে যেতে পারছে না। ভিডিয়ো কনফারেন্সে শুনানি বানচাল করতেই পোড়া স্বপনের দলবলের সঙ্গে মিশে ওই বন্দিরা ভিডিয়ো কনফারেন্সের সরঞ্জাম ভাঙচুর করে। সংশোধনাগারের মধ্যে নির্মাণ কাজ চলছে। সেই নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে বন্দিরা দীর্ঘ ক্ষণ জেলে ঢোকার রাস্তা বন্ধ করে রেখে দেয়। ফলে বাইরে থেকে বাহিনী প্রথমে ঢুকতে পারেনি। মুক্তাঞ্চল পেয়ে তাণ্ডব চালায় বন্দিরা।
কিন্তু সংশোধনাগারের ভিতরের যে ভিডিয়ো প্রকাশ্যে এসেছে, সেখানে বন্দিদের বয়ানে উঠে এসেছে অন্য বক্তব্য। তাঁরা সেখানে দাবি করছেন, ‘‘এখানে ইউটি (বিচারাধীন) এবং কনভিক্ট (সাজাপ্রাপ্ত)-দের মধ্যে কোনও লড়াই নেই। জেলের অফিসাররা মিথ্যা কথা বলছেন।” ভিডিয়োতে, বন্দিদের বয়ানে উঠে এসেছে জেল আধিকারিকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ। এক বন্দিকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘‘জেলের মধ্যে যে ফোন পাওয়া যাচ্ছে তা কোথা থেকে আসছে? আমাদের জেলের বাইরে বেরনোর সময় বা জেলে ঢোকানোর সময় সার্চিং হচ্ছে। জেলের বড়বাবু সুখেন্দুবাবু আমাদের ফোন দিচ্ছেন। জেলর স্বপন দাস আমার কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা নিয়েছেন। কেন? আমাকে বলেছেন, জেলের মধ্যে তুই ফোন চালা। কেস চালা। কোনও সমস্যা নেই। স্বপনবাবুও জেলে ফোন দিয়ে যাচ্ছেন আমাদেরকে। বলছেন, বড় ফোন জেলে ঢোকালে (স্মার্ট ফোন) ৪ হাজার টাকা দিতে হবে। ছোট ফোন হলে ২ হাজার টাকা। তা হলে জেল কি ব্যবসা করার জায়গা?”
অন্য এক বন্দির ভিডিয়ো প্রকাশ্যে এসেছে। সেখানে তাঁর অভিযোগ, ‘‘আমাকে কোনও কারণ ছাড়াই সেলে বন্দি করে দেওয়া হয়েছে। আমি জেল আধিকারিকদের ঘুষ চাওয়ার প্রতিবাদ করে ডিজি অরুণ গুপ্তকে দু’টি চিঠি দিয়েছি। অথচ কেউ আমার সঙ্গে কথা বলতে আসেননি। বাধ্য হয়ে আমি পাঁচ দিন ধরে অনশন করছি। তা-ও জেল কর্তৃপক্ষ ভ্রূক্ষেপ করছেন না।”
আরও পড়ুন: ভারত মাতা কি জয় নিয়েও অসুবিধা? মনমোহনকে কটাক্ষ মোদীর
এ রকমই একের পর এক বন্দি জেল আধিকারিকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন। জেল আধিকারিকদের একাংশ সূত্রে খবর, প্যারোলে সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের ছাড়া নিয়ে বড়়সড় চক্র চলছে সংশোধনাগারের ভিতরে। নিয়ম অনুসারে সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের প্যারোলে ছাড়ার ক্ষমতা রয়েছে কারা দফতরের অধির্কতা বা ডিরেক্টর জেনারেলের (ডিজি)। সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের আত্মীয়দের অভিযোগ, জেলের আধিকারিকদের মোটা নজরানা না দিলে প্যারোল পাওয়া যাচ্ছে না। এক জেল আধিকারিক বলেন, ‘‘প্যারোলে ছাড়া পাওয়া বন্দির আইনি অধিকার। প্রতি ৬ মাস অন্তর যে কোনও সাজাপ্রাপ্ত বন্দি একটানা ১৫ দিন পর্যন্ত বাড়িতে থাকতে পারেন। তবে তা ডিজিকে অনুমোদন করতে হয়।’’
পার্ক স্ট্রিটের সাব্বির আলম বা উল্লু রাজুর পরিবারের অভিযোগ, বাবা মারা যাওয়ার সময় উল্লু জেল কর্তৃপক্ষের কাছে শর্ট প্যারোল বা কয়েক ঘণ্টার জন্য বাড়ি যেতে চেয়েছিল। বাবার শেষকৃত্যে যোগ দিতে। অভিযোগ, জেল আধিকারিকদের দাবি না মেটানোয় বাবার শেষকৃত্য হয়ে যাওয়ার পর রাত ১১টায় তাকে ছাড়া হয়।
এই সংশোধনাগারেই বন্দি পার্ক স্ট্রিট গণধর্ষণে সাজাপ্রাপ্ত সুমিত বাজাজ এবং নাসের খান। অন্য বন্দিদের আত্মীয়দের অভিযোগ, নাসির-সুমিতরা বছরে নির্দিষ্ট দু’বারের বদলে তিন বার প্যারোলে ছাড়া পাচ্ছে। ডিজির সুপারিশে তাদের সাজার মেয়াদও কমছে। অভিযোগ, সবটাই হচ্ছে নাসিররা জেলে মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করে বলে। সাধারণ বন্দি বা যাঁদের সেই টাকা খরচ করার সামর্থ্য নেই তাঁরা সমস্ত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
এ বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘‘কোনও অন্যায় বরদাস্ত করা হবে না। ভাঙচুর যারা করেছে তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। পাশাপাশি কোনও কারা কর্মী দুর্নীতিগ্রস্ত কি না সেটাও খতিয়ে দেখা হবে।”