নিহত রামবাবুর মা রেখা সাউ। নিজস্ব চিত্র
রুটিগুলো বাসি। ফেলে দিয়েছেন বাড়ির লোকেরা। কিন্তু মায়ের মন তো! একদিন হয়ে গেল ছেলে অভুক্ত। তাই শুক্রবার ফের ভাত রেঁধে বসে আছেন রেখা সাউ। যে আসছে, তাঁকেই বলছেন, “রাম যে কোনও সময় এসে বলবে, মা, চাওল বন গেইলবা। খানা দে।” বলেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠছেন রেখা।
আত্মীয়-পড়শিরা রেখাকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, রামবাবু আর নেই। গুলি লেগে মারা গিয়েছে। মাঝে মাঝে সে কথা তিনিও বলছেন। পরক্ষণেই জিজ্ঞাসা করছেন, ‘‘রাম কখন আসবে?’’ পড়শি লক্ষ্মী বলেন, “ছেলের রক্তাক্ত দেহ দেখার পর থেকেই এমন হয়ে গিয়েছে রেখা।”
রামবাবুর বাড়ি থেকে কিছুটা এগিয়ে ধর্মবীরের একচিলতে বাড়ি। সেখানের ছোট্ট দুই বাসিন্দা নবম শ্রেণির সুজল আর ষষ্ঠ শ্রেণির নাতাশা সাউ অবশ্য বুঝে গিয়েছে, তাদের ‘পাপা’ ধর্মবীর সাউ আর কোনওদিন বাড়ি ফিরে তাদের বলবে না, “আঁখে বন্ধ করো। দেখো, তুমলোগোকে লিয়ে কেয়া লায়া হুঁ।” হাসতে হাসতে ভাই-বোন আর কোনওদিন বলার সুযোগ পাবে না যে, “আপ ভি না! আঁখে বন্ধ করকে ক্যায়সে দেঁখু?” কথাগুলো বলেই কেঁদে ফেলে নাতাশা। সুজলের চোখ লাল, কিন্তু জল নেই। সে বলে, “আমাদের কথা শুনে পাপা বলত, আমি তো আনপড়। তোকে বড় ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে।”
বৃহস্পতিবার ভাটপাড়ার কাঁকিনাড়ায় গুলিতে খুন হয়েছেন কাছারি রোডের বছর সতেরোর কিশোর রামবাবু আর মাঝবয়সি ধর্মবীর। দু’জনেই ফুচকা বেচে সংসার চালাতেন। ধর্মবীর মাঝেমধ্যে চটকলে ঠিকা শ্রমিকের কাজ করতেন। বাবুরাম অল্প বয়সেই বাবাকে হারিয়েছে। দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছে। দুই দাদা আলাদা থাকেন। মা রেখাকে নিয়েই ছিল তার সংসার।
কাছারি রোড লাগোয়া গলি থেকে যে রাস্তাটা টালি ছাওয়া দেড় কামরার ছোট্ট ঘরে গিয়েছে, তাতে পাশাপাশি দু’জন হাঁটা যায় না। ঘরে রাখা একটি তক্তাপোষ। তার সামনে একটি ছোট্ট কাঠের পিঁড়িতে বসেছিলেন রেখা। পাশে রাখা ভাতের হাঁড়ি। ছেলের কথা জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, “আমি রুটি করছিলাম। ও পায়ে চপ্পল গলিয়ে বাইরে বেরোচ্ছিল। আমি খাবার দিতে গেলে বলল, ধীরেসুস্থে বানাও। এসে খাব। সেই যে গেল, আর ফিরল না!”
এলাকার ঘরে ঘরে এখন কথা এই দু’জনকে নিয়েই। সবার মুখে একই কথা, রাজনীতির সঙ্গে কোনও যোগই ছিল না রাম আর ধর্মবীরের। অথচ, রাজনীতির আবর্তে পড়েই মরতে হল দু’জনকে। যেমন ভাবে ১০ জুন ভাটপাড়াতেই বোমায় খুন হন রাজনীতি থেকে শতহস্ত দূরে থাকা মহম্মদ হালিম ও মহম্মদ মোক্তার।
শুক্রবার বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিংহ জানান, রামবাবু ও ধর্মবীরের পরিবারকে ১০ লক্ষ করে টাকা ও একটি চাকরি দেওয়ার জন্য কেন্দ্রের কাছে সুপারিশ পাঠানো হচ্ছে। হালিম ও মোক্তারের পরিবারকে এর মধ্যে দু’লক্ষ টাকা করে দিয়েছে তৃণমূল। তাঁদের পরিবারকে চাকরি দেওয়া কথা ঘোষণাও করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।