‘এই সীমান্তকে আমরা চিনি না’, বিস্মিত প্রবীণেরাও

মাঝপদ্মায় ভাসতে ভাসতে কখনও কখনও আন্তর্জাতিক সীমানা মুছে ফেলত ছোট-বড় নৌকাগুলো। এক নৌকা থেকে অন্য নৌকায় পৌঁছে যেত রান্নার আগুন, তেল, নুন, মশলা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কাকমারি চর শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০১৯ ০২:০৮
Share:

প্রণবকে (চিহ্নিত) নিয়ে চারঘাট থানার পুলিশকর্মীরা। নিজস্ব চিত্র

আষাঢ়ের ভরা পদ্মা। তুমুল ঝড়-বৃষ্টিতে নৌকাটা কোন দিকে যাচ্ছে বুঝতে পারেননি জলঙ্গির কাজিপাড়ার মৎস্যজীবী সুরেন মণ্ডল। ঢেউয়ে দুলতে দুলতে তাঁর নৌকা ভিড়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের সীমানায়। তখনও বিডিআর বিজিবি হয়নি। বিডিআর পরিস্থিতি বুঝে অসহায় সুরেনকে নিয়ে গিয়েছিল নিজেদের ক্যাম্পে। পড়শি দেশের সীমান্তরক্ষীরা তাঁকে খেতে দিয়েছিলেন গরম দুধ আর খাবার। তার পরে ঝড়-বৃষ্টি থামতেই ফের তাঁকে নৌকায় তুলে দিয়ে সাবধানে দেশে ফেরার পরামর্শ দিয়েছিল বিডিআর।

Advertisement

সুরেন মারা গিয়েছেন বছর কয়েক আগে। কিন্তু কয়েক দশক আগের এই ঘটনা এখনও সীমান্তের ধীবরদের মুখে মুখে ঘোরে। লালকুপ মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি জুলফিকার আলি বলছেন, ‘‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গিয়েছে সীমান্তের মানচিত্র, পদ্মার চেহারা। দু’দেশের সীমান্তরক্ষীদের মধুর সম্পর্কটাও ফিকে হয়েছে। একটা সময় বিএসএফ ও বিডিআর, দু’পক্ষই বুঝত দেশ নয়, আসলে ভাগ হয়েছে হৃদয়। ফলে তারাও মানবিক আচরণ করত।’’

সীমান্তের প্রবীণেরা বলছেন, ‘‘এই সীমান্ত আমাদের কাছে অচেনা। এ পার হোক বা ও পার, কারও কোনও দুর্ঘটনা ঘটলেও দু’দেশের সীমান্তরক্ষীরা ছেড়ে দিতেন। বলতেন, ‘যাও দিনের আলো থাকতে থাকতেই ফিরে এসো।’ এ ভাবেই বিএসএফকে বলে একছুটে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে বিয়ে হওয়া মেয়েটাকে এক বার দেখে আসতেন অনেকেই।’’

Advertisement

মাঝপদ্মায় ভাসতে ভাসতে কখনও কখনও আন্তর্জাতিক সীমানা মুছে ফেলত ছোট-বড় নৌকাগুলো। এক নৌকা থেকে অন্য নৌকায় পৌঁছে যেত রান্নার আগুন, তেল, নুন, মশলা। ধীবর শক্তি মণ্ডল বলছেন, ‘‘রান্না করা খাবারও আমরা ভাগ করে খেতাম। পদ্মায় তখন ছিল আমাদের ঘরবাড়ি। এ দেশ, ও দেশ বুঝতাম না। সবাইকে নিয়েই ছিল অন্য রকম সংসার।’’

সীমান্তের বাসিন্দা ও মৎস্যজীবীরা জানাচ্ছেন, বছর পনেরো থেকে সীমান্তের চেহারাটা বেশ বদলে গিয়েছে। দূরত্ব বেড়েছে বিএসএফ ও বিজিবি-র মধ্যেও। কিন্তু তার পরেও সীমান্তের ছোটখাটো সমস্যা ফ্ল্যাগ মিটিংয়েই মিটে যেত।

পড়শি জেলা নদিয়ার কাছারিপাড়ার বাসিন্দা শঙ্কর মণ্ডল নিজেও পদ্মাপাড়ের বাসিন্দা। এলাকার একাধিক সমস্যার সমাধান করতে বিএসএফের সঙ্গে বিডিআর ও বিজিবি-র একাধিক ফ্ল্যাগ মিটিংয়ের সাক্ষী থেকেছেন।

জলঙ্গির কাকমারি চরের ওই ঘটনার পরে বিস্মিত শঙ্করবাবু বলছেন, ‘‘ফ্ল্যাগ মিটিংয়ে নানা রকম চাপানউতোর দেখেছি। কিন্তু দুম করে এমন গুলি চালিয়ে দেওয়া এবং বিএসএফ জওয়ানের মৃত্যু আগে কখনও ঘটেছে বলে মনে করতে পারছি না। তদন্তে নিশ্চয় প্রকৃত ঘটনা উঠে আসবে। তবে এটা কোনও ভাবেই প্রত্যাশিত ছিল না।’’

কাকমারি শিরচরের ধীবরদের দাবি, দু’বছর আগেও শিরচরের সুকুমার মণ্ডল, অশোক মণ্ডল, শক্তি মণ্ডলদেরও আট করেছিল বিজিবি। কিন্তু এক দিন পরেই ফ্ল্যাগ মিটিংয়ের মাধ্যমে ঘরে ফিরেছিেলন তাঁরা।

বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের রাজশাহির চারঘাট উপজেলা সদরের বালুঘাটে গুলি কাণ্ডের আগের দিনও জলঙ্গির ক্ষিতীশ মণ্ডল, অনুপ মণ্ডল, অশোক মণ্ডলের কাছ থেকে গোটা কয়েক ইলিশ নিয়েই তাঁদের সীমান্ত থেকে ফিরিয়ে দিয়েছিল বিজিবি। বলেছিল, ‘এত দূরে মাছ ধরতে আসবে না।’ তা হলে ঠিক তার পরের দিন, বৃহস্পতিবার কী এমন ঘটনা ঘটল যার জেরে গুলি ছুড়তে হল?

ঘটনার পাঁচ দিন পরেও এই প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি বিএসএফের কাছে। যে দু’জন মৎস্যজীবী বিএসএফের সঙ্গে ছিলেন তাঁরাও ঘটনার পর থেকে মুখে কুলুপ এঁটেছেন। করজোড়ে তাঁরা বারবারই বলে চলেছেন, ‘‘আমরা আর নতুন করে কোনও বিপদে পড়তে চাই না।’’ এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারতেন যিনি সেই মৎস্যজীবী প্রণব মণ্ডল এখনও বাংলাদেশ পুলিশের হেফাজতে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement