জগদীপ ধনখড় ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।
এ বার আর লিখিত বিবৃতি নয়। রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি মুখ খুললেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়।
রীতিমতো সাংবাদিক সম্মেলন করে মঙ্গলবার শিলিগুড়িতে তাঁর ঘোষণা, ‘‘রাজ্যে এখন এক নিস্পৃহতার (লিউকওয়ার্ম) পরিবেশ চলছে।’’ সেই সঙ্গেই তিনি হুঁশিয়ারি দেন, ‘‘আমি রাজনৈতিক সার্কাস করতে আসিনি। আমার অবস্থান সাংবিধানিক। সংবিধান মেনেই কাজ করছি। কোনও রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা আমার নেই।’’
তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পাল্টা বক্তব্য, ‘‘রাজ্যপাল স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তিনি নিরপেক্ষ নন। রাজ্যপালের উচিত প্রতিদিন রাজনৈতিক গিমিক তৈরি বন্ধ করা। সংবিধানের অসৎ ব্যবহার করা উচিত নয়।’’
কয়েক ঘণ্টার সফরে এ দিন শিলিগুড়ি গিয়েছিলেন ধনখড়। প্রথমে মারোয়ারি সমাজের একটি অনুষ্ঠান, তারপর একটি বণিক সভার অনুষ্ঠান, দার্জিলিং জেলার জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক এবং সর্বশেষ রাজ্য সরকারের অতিথি নিবাসে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে ঘণ্টাখানেক প্রশ্নোত্তর পর্ব— এই ছিল তাঁর গোটা দিনের কর্মসূচি। সন্ধ্যায় বাগডোগরা থেকে সস্ত্রীক রাজ্যপাল উড়ে যান দিল্লি।
রাজ্যপাল হওয়ার পরে এটিই ছিল তাঁর প্রথম জেলা সফর। রাজভবন থেকে আগাম জানানো হয়েছিল, শিলিগুড়িতে তিনি দার্জিলিং জেলার সাংসদ, বিধায়ক, শিলিগুড়ির মেয়র এবং মহকুমা পরিষদের সভাধিপতিদের সঙ্গে দেখা করবেন। জানানো হয়েছিল, সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়ার কথাও।
তবে যা হল তা কার্যত সাংবাদিক সম্মেলন এবং সেখানে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে রাজ্যকে খোঁচা দিতে কার্পণ্য করলেন না রাজ্যপাল। সাধারণত এই পদে যাঁরা বসেন খুব গুরুতর কারণ ছাড়া তাঁরা সরাসরি সাংবাদিক সম্মেলন করেন না। সে দিক থেকে ধনখড়ের ভূমিকা নজিরবিহীন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই।
রাজ্যপাল পদে ৩০ জুলাই শপথ নেন ধনখড়। তার অল্প দিন পর থেকেই তাঁর বিভিন্ন কার্যকলাপ সরকারের অপছন্দের কারণ হয়েছে। এ নিয়ে তাঁর সাম্প্রতিক দিল্লি সফরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের কাছে ক্ষোভও জানান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ঘটনাচক্রে সেই দিন বিকেলেই ঘটে যাদবপুর-কাণ্ড। যাকে কেন্দ্র করে রাজ্যপাল-সরকার সংঘাত তীব্র আকার নেয়। সেই আবহেই ধনখড়ের এ দিনের শিলিগুড়ি সফর।
রাজ্যপালের ডাকা জনপ্রতিনিধিদের বৈঠকে তৃণমূলের কেউ যাবেন না, এটাই ছিল দলীয় সিদ্ধান্ত। ছিলেন, বিজেপির সাংসদ-বিধায়ক, কংগ্রেসের বিধায়ক এবং সিপিএমের বিধায়ক-মেয়র। যাননি দার্জিলিংয়ের জেলা শাসক, পুলিশ কর্তাও। এমনকি, বণিক সভার অনুষ্ঠানে নাম থাকা সত্ত্বেও অনুপস্থিত ছিলেন রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব।
রাজ্যপাল সেই প্রসঙ্গ তুলে বলেন, ‘‘রাজ্যের মন্ত্রী গৌতম দেবের আসার কথা ছিল। স্বরাষ্ট্র বিভাগের সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের আসার কথা ছিল। অন্য কর্মসূচির জন্য তাঁরা আসতে পারেননি বলে শুনেছি। আমি প্রোটোকলকে খুব গুরুত্ব দিই না। তবে খুশি হতাম, কলকাতার বাইরে রাজ্যপাল হিসেবে প্রথম অনুষ্ঠানে রাজ্য প্রশাসন আর একটু সক্রিয় হলে। রাজ্য প্রশাসনের অফিসারেরাও নিশ্চয় বিশেষ কারণে আসতে পারেনি। জেলা শাসক ছুটিতে গিয়েছেন। পুলিশ কর্তারাও আসতে পারেননি। সকলে একসঙ্গে আটকে গিয়েছেন। আশা করি, পরের বার এ রকম হবে না।’’
তিনি আরও জানান, দার্জিলিংয়ের বিজেপি সাংসদ রাজু বিস্তা, কংগ্রেস বিধায়ক শঙ্কর মালাকার, সিপিএম বিধায়ক তথা মেয়র অশোক ভট্টাচার্য, শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদের সভাধিপতি সিপিএমের তাপস সরকার সকলেই তাঁকে বিভিন্ন বিষয়ে লিখিত ভাবে নানা প্রস্তাব দিয়েছেন। বিভিন্ন সমস্যার কথাও জানিয়েছেন। সে গুলি খতিয়ে দেখে তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।
তাঁর এ ধরনের জেলা সফর যে চলবেই সে কথা জানিয়ে ধনখড় বলেন, ‘‘আমি কোনও রুদ্ধদ্বার বৈঠক করিনি। রাজ্যের সবক’টা জেলায় যাব। কোথায় কোন দল শক্তিশালী সেটা দেখা আমার কাজ নয়। আমার সফর নিয়ে কে কী বললেন, সেটা দেখাও আমরা কাজ নয়। আমি আমার কাজ করব। আমি ইতিবাচক মানুষ। সমাধান খুঁজতে চাই। আমার মনে হয় একমাত্র সহমতের মাধ্যমেই সমাধানসূত্রে পৌঁছনো সম্ভব।’’
তাঁর এই সফরের মধ্যে ‘রাজনীতি’ নেই বলে দাবি করে ধনখড়ের আরও বক্তব্য, ‘‘সংবিধানকে রক্ষা করা এবং পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে সেবা করার শপথ নিয়ে রাজ্যপাল হয়েছি। এটা আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। আমি ‘কপিবুক’ রাজ্যপাল। সাংবিধানিক ক্ষমতা এবং অনুচ্ছেদের ৯ এবং ৯এ ধারা অনুসারে আমরা ক্ষমতা সম্পর্কে আমি ওয়াকিবহাল। আমি অতি সক্রিয় নই। সক্রিয়। তা না হলে তো নিষ্ক্রিয় বলা হবে।’’
প্রতিক্রিয়ায় তৃণমূলের মহাসচিব তথা রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বিবৃতি দিয়ে জানান, ‘‘চেয়ারে বসার ১৫ দিনের মধ্যেই নতুন রাজ্যপাল সরকার এবং সরকারের আধিকারিকদের নিয়ে পক্ষপাতদুষ্ট মন্তব্য করেছেন। দেশের সংবিধান অনুসারে রাজ্য সরকার নির্বাচিত সংস্থা। কেন্দ্রীয় সরকারও তাই। কিন্তু রাজ্যপাল মনোনীত পদ, নির্বাচিত নয়। সংবিধান রাজ্য সরকার এবং রাজ্যপালের কাজের পরিসরের তফাত স্পষ্ট করে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ খুব সুন্দর জায়গা। রাজ্যপাল বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যেতে পারেন এবং রাজ্য সরকারের আতিথেয়তা গ্রহণ করতে পারেন। সেটাই কাম্য।’’