—ফাইল চিত্র
তাঁর জীবনের শেষ দিনে নানা ব্যস্ততায় ডুবে ছিলেন মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী। তবু সাত-সকালের প্রাত্যহিক বাংলা ক্লাসে ফাঁকি দেননি তিনি। সেই গাঁধীকে কি কখনও বাংলাজ্ঞানের বহর মেলে ধরতে দেখা গিয়েছে?
প্রশ্নটা শুনে হাসলেন ইতিহাসবিদ সুগত বসু। “গাঁধী তো রবীন্দ্রনাথের কবিতা মূল ভাষায় পড়তে চান বলে বাংলা শিখছিলেন। তিনি অহিংস রাজনীতি করলেও বাংলা তাঁর কাছে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের বীরদেরও ভাষা।” দেশভাগের সময়ের হিংসা, বিদ্বেষের পটভূমিতে গাঁধী আজাদ হিন্দ ফৌজে তাঁর প্রিয় সুভাষের সম্প্রীতির আদর্শের কাছেও কার্যত হাত পেতেছিলেন। বার বার বলেছিলেন, দেশের সঙ্কটে এই অ-সাম্প্রদায়িক বাংলাই পারে ভারতকে পথ দেখাতে। সুগতের মতে, “এই সব নানা কারণে গভীর শ্রদ্ধা ও আকর্ষণ থেকেই গাঁধী বাংলা শিখছিলেন। আজকের রাজনীতির নব্য বাংলা অনুরাগীদের সঙ্গে সুস্পষ্ট তাঁর ফারাক।”
এই ২০২০-২১এর ভারতে কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথ, অরবিন্দ থেকে স্বল্প পরিচিত বাঙালি কবিদের উদ্ধৃতিতেও মুখর নরেন্দ্র মোদী। অমিত শাহের তো রবিবারগুলো আকছার বাংলাতেই কাটছে। বাউলগান থেকে বেগুন ভাজা, সবই তাঁর মেনুতে আবশ্যক। শোনা যাচ্ছে, তিনিও সাত দিন ছুটি নিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতে ডুব দিতে উন্মুখ।
বাংলা ভাষা বা রবীন্দ্রনাথ, কোনওটাই জন্মসূত্রে বাঙালির সম্পত্তি নয়। তবে ভাষা নিয়ে আবেগে সুড়সুড়ি দিয়ে ভোটকে পাখির চোখ করলেও তা সহজেই ধরা পড়ে! জন্মসূত্রে মালয়ালি, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মনোজ মুরলী নায়ার বিরক্ত, ‘‘এই সব নেতাদের আলটপকা বাংলা বলায় ছিটেফোঁটা শ্রদ্ধা বা চর্চার ছাপ পাই না। রবীন্দ্র আদর্শের ধারেকাছে না-হেঁটে রবীন্দ্রনাথকে ব্যবহার করাটাও গায়ে লাগে।"
বহু অ-বাংলাভাষী গুণিজন বাংলায় গবেষণার কাজে নিজেকে নিবেদন করেছেন। তালাত মাহমুদ থেকে লতা মঙ্গেশকরদের বাংলা গান কয়েক প্রজন্মের বাঙালির সহচর। ২০২১কে আবাহনের লগ্নে বাঙালির রসিকতার লব্জে কিন্তু মিশে যাচ্ছে খোদ প্রধানমন্ত্রীর মুখ নিঃসৃত ‘রাবীন্দ্রিকতা’! ‘চোলায় চোলায় বাজবে জয়ের ভেরী’ থেকে ‘ওরে গ্রহবাসী...’
“বাংলা চর্চায় প্রাদেশিকতা মানি না। কিন্তু ভোট-রাজনীতিতে এই ভাষা-সংস্কৃতির চর্চা একেবারেই অন্তঃসারশূন্য, কদর্য”, বলছেন অর্থনীতির অধ্যাপক সৌরীন ভট্টাচার্য। তবে বাঙালির সাম্প্রতিক স্মৃতিতে সব দলই কমবেশি ভাষা-রাজনীতির শরিক। ২০২০এর শেষে নেটরাজ্যে তুমুল জনপ্রিয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি ভিডিয়ো। তাতে দাবি, গুজরাতি থেকে রুশ, কত ভাষা মমতা জানেন! যেখানে যান, সেখানেই ভাষা শিখে নেন।
রাজনীতির ক্ষেত্রে ভাষাকে হাতিয়ার করার কৌশল অবশ্যই নতুন নয়। তাই মোদী-শিবিরের সাম্প্রতিক বাংলা-প্রীতিতে তাঁদের কথার সঙ্গে কাজের মিলটুকু জরিপ করার পক্ষপাতী জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক মিনতি পান্ডা বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্বের বিভাগীয় প্রধান সমীর কর্মকার। কেন্দ্রের নয়া শিক্ষা নীতিতে ত্রিভাষিক ফর্মুলায় অনেকেই হিন্দি চাপানোর ছক দেখছেন। মিনতির কথায়, “ক্ষমতা দখলের চেষ্টায় নেতাদের বাংলা সংস্কৃতি আত্মসাৎ করার এই চাল দেখে ভোলবার আগে বাঙালির মাথা খাটানো উচিত।” পরশুরামের রামরাজ্য গল্পে প্রেতচক্রের আসরে ডাক পেয়ে সর্বজ্ঞ হনুমান স্বয়ং বাংলায় কথা বলেছিলেন। তিনি জানতে চান, মানভূমী না ঢাকাই, বাগবাজারি না বালিগঞ্জি কোন বাংলায় কথা বলবেন!
বাঙালির মন জয়ে ভোটরঙ্গে দিল্লির নেতা অবতারদের রকমারি বাংলা উপস্থাপনায় আপাতত ফাঁক থাকছে না।