সড়ক পরিকাঠামোর খাতে পশ্চিমবঙ্গের ভাঁড়ারে ক্রমশই বেড়ে চলেছে কেন্দ্রীয় বরাদ্দের জোগান।
একশো দিনের কাজ বা প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার মতো প্রকল্পে বরাদ্দ বন্ধই আছে এবং যথারীতি বহাল আছে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বঞ্চনার অভিযোগ। এর মধ্যে ব্যতিক্রম অবশ্য সড়ক পরিকাঠামো। ওই খাতে পশ্চিমবঙ্গের ভাঁড়ারে ক্রমশই বেড়ে চলেছে কেন্দ্রীয় বরাদ্দের জোগান।
জমি-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা তৃণমূল সরকারের অন্যতম নীতি হল, জোর করে জমি অধিগ্রহণ করা হবে না। প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের মতে, সেই রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে জমি-সমস্যাই হয়ে উঠেছিল শিল্পায়ন এবং বড় সড়ক পরিকাঠামো তৈরির অন্যতম কাঁটা। তবে প্রশাসনের খবর, অন্তত সড়ক প্রকল্পের প্রশ্নে আগের তুলনায় সহজে জমি জোগাড় করা যাচ্ছে বলেই গত কয়েক বছর ধরে এই খাতে কেন্দ্রের বরাদ্দ বাড়ছে উল্লেখযোগ্য হারে।
কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ মন্ত্রকের আর্থিক বরাদ্দে এ রাজ্যের পূর্ত বিভাগের জাতীয় সড়ক শাখা ২৯টি জাতীয় সড়কের প্রায় ১৬৪০ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি এবং সম্প্রসারণের দায়িত্বে রয়েছে। তাতে ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষে এ রাজ্যের ভাগে জুটেছিল মাত্র ১৫৩ কোটি টাকা। করোনাকাল বাদে সেই অঙ্কই ২০২২-২৩ আর্থিক বছরে লাফিয়ে পৌঁছেছে ২৩০৬ কোটিতে। রক্ষণাবেক্ষণ খাতেও ২০২১-২২ অর্থবর্ষে যা ছিল ৭০ কোটি টাকা, ২০২২-২৩ বছরে তা পৌঁছেছে ১৬০ কোটিতে (সবিস্তার সারণিতে)। এ ছাড়াও এনএইচএআই বা জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নতুন সড়ক এবং রক্ষণাবেক্ষণ খাতে প্রতি বছর পাওয়া যায় আরও প্রায় পাঁচ-ছ’হাজার কোটি টাকা।
সড়ক বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, সড়ক প্রকল্পে কেন্দ্রের অন্যতম শর্তই হল নির্বিঘ্নে জমির সংস্থান। সেই দায়িত্ব প্রধানত থাকে রাজ্য সরকারের উপরেই। অতীতে বহু নতুন রাস্তা বা সম্প্রসারণের জন্য জমি-জটই অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক তার বড় উদাহরণ। সহজে জমি না-পাওয়ায় টান পড়েছিল কেন্দ্রীয় বরাদ্দেও। কিন্তু গত কয়েক বছরে পরিস্থিতির কিছুটা বদল লক্ষ করা গিয়েছে। জাতীয় জমি অধিগ্রহণ আইন অনুযায়ী প্রকল্পের জন্য জমি নেওয়া হলেও তাতে স্থানীয় প্রশাসন এবং রাজনৈতিক সহযোগিতা থাকছে। কেন্দ্রের প্রস্তাবিত বারাণসী-কলকাতা, খড়্গপুর-মোড়গ্রাম, রক্সৌল-হলদিয়ার মতো আর্থিক করিডর নির্মাণের জন্য জমি সংগ্রহের প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন। জমি জোগাড় করে দ্বিতীয় হুগলি সেতু থেকে কোনা এক্সপ্রেসওয়ের উপর দিয়ে ৬ নম্বর জাতীয় সড়ক পর্যন্ত ‘এলিভেটেড করিডর’ বা উড়ালপথ তৈরির কাজও শুরুর মুখে।
প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “রাজ্য সরকার জোর করে জমি নেওয়ার বিরোধী। তবে মানুষকে বুঝিয়ে এবং তাঁদের সম্মতিতে জমি নিতে বাধা নেই।” পর্যবেক্ষকদের মতে, পরিকাঠামো উন্নয়নের প্রশ্নে জমি-সমস্যা বাধা হয়ে না-দাঁড়ালে হয়তো আরও অর্থ আসত রাজ্যের ভাঁড়ারে। কারণ, অন্য অনেক রাজ্যে জমি-সমস্যা না-থাকায় তারা অনেক বেশি অর্থ (সবিস্তার সারণিতে) পাচ্ছে। রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তার কথায়, “যে-আর্থিক পরিস্থিতি চলছে, তাতে কেন্দ্রের বরাদ্দ না-বাড়লে এই ধরনের পরিকাঠামো খাতে খরচ করা বেশ কঠিন। কারণ, নিত্যকার দফতর-ভিত্তিক খরচ, বেতন-পেনশন, ঋণ শোধ, সামাজিক অনুদান প্রকল্পগুলির দায়িত্ব মিটিয়ে পরিকাঠামো খাতে খরচের জন্য প্রায় কিছুই থাকে না।”
সড়ক বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, এর পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ মন্ত্রকের সঙ্গে সমন্বয়ের ভিত্তিতে রাজ্যের পূর্তকর্তাদের পদক্ষেপও বরাদ্দ বৃদ্ধির সহায়ক হয়েছে। ২০২১-২২ বছরে শিলিগুড়ির উড়ালপথ প্রকল্পে বরাদ্দ হয়েছে ৯৯৫ কোটি টাকা। দীর্ঘ কাল আটকে থাকা রানিগঞ্জ, দুবরাজপুর, রামনগর-বালিসাই বাইপাসের ছাড়পত্র মিলেছে ২০২২-২৩ সালে। দার্জিলিং ও সিকিম যাওয়ার পাহাড়ি জাতীয় সড়কের কাজ হয়েছে। বঙ্গের পূর্ত দফতরের জাতীয় সড়ক শাখার কাজের প্রশংসাও করেছে সিকিম হাই কোর্ট।
“কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের পূর্ত দফতরের আধিকারিকেরা যে-সমন্বয় করে কাজ করেছেন, তাতে প্রকল্পের ছাড়পত্র আদায় করে নিতে কোনও সমস্যা হয়নি,” বলেন প্রশাসনের এক কর্তা।