ফাইল চিত্র।
বাজেটের আগে আর্থিক সমীক্ষায় জানানো হয়েছে, চলতি বছরে ভারতীয় অর্থনীতি ৯ শতাংশেরও বেশি হারে বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে জাতীয় আয় এখন অতিমারি পূর্ববর্তী অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে আর্থিক সমীক্ষা ভবিষ্যৎবাণী করছে, আগামী বছরে ৮%-৮.৫% হারে অর্থনীতির বৃদ্ধি ঘটবে। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন যে রকম বাজেট পেশ করলেন তাতে এই ভবিষ্যৎবাণী নিয়ে সংশয় জাগে। ৮%-৮.৫% হারে বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য জিনিসপত্রের চাহিদা যতটা বাড়া দরকার, ততটা বাড়বে তো? সংশয় সেখানেই।
মোট চাহিদাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়— সরকারি বিনিয়োগজনিত চাহিদা, বেসরকারি বিনিয়োগজনিত চাহিদা এবং বেসরকারি ভোগজনিত চাহিদা। সরকারি ভোগজনিত চাহিদাও একটা আছে। কিন্তু সেটা দিনে দিনে কমছে বলে তাকে হিসেব থেকে বাদ দিচ্ছি। বাজেটে সরকারি বিনিয়োগ ৩৫.৪% বেড়েছে। এটা নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য একটা বৃদ্ধি। এই বিনিয়োগের বেশিরভাগটাই পরিকাঠামো নির্মাণে খরচ করা হবে। অর্থমন্ত্রী আশা করছেন, সরকারি বিনিয়োগ বাড়লে বেসরকারি বিনিয়োগও বাড়বে। অর্থশাস্ত্রে একে বলা হয় ‘ক্রাউডিং ইন এফেক্ট’। সরকারি বিনিয়োগের ফলে পরিকাঠামোয় উন্নতি ঘটলে বেসরকারি বিনিয়োগের উৎপাদনশীলতা বাড়ে, ফলে বেসরকারি বিনিয়োগও বাড়ার কথা। আবার সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে, মানুষের হাতে টাকা আসবে, ফলে বেসরকারি ভোগও বাড়বে। এই ‘ভার্চুয়াস সাইক্ল্’ বা শুভচক্রের কথা অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তৃতায় একাধিক বার উল্লেখ করেছেন। এক বার এই চক্র ঘুরতে শুরু করলে আট-সাড়ে-আট কেন, তার থেকে বেশি হারেও ভারতীয় অর্থনীতি বৃদ্ধি পেতে পারে।
কথা হচ্ছে, সরকারি বিনিয়োগ বাড়লেই যে সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতির চাকাটা ঘুরতে শুরু করবে তার কোনও মানে নেই। ধরা যাক, সরকারি বিনিয়োগ বাড়ার ফলে বেসরকারি বিনিয়োগের উৎপাদনশীলতা একটু একটু করে বাড়তে শুরু করল। কিন্তু বাজারে যদি পণ্যের চাহিদা না থাকে তাহলে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়বে না। পণ্যের চাহিদার মূলে আছে মধ্যবিত্তদের আয়। কারণ মধ্যবিত্তেরাই বাজারে মূল ক্রেতা। বড়লোকেরা সংখ্যায় অল্প, তাঁদের সঞ্চয় বেশি, খরচ কম, খরচ করলেও তাঁরা বিদেশি পণ্য কেনা পছন্দ করেন। ফলে তাঁরা বাজারের মূল ক্রেতা নন। আর গরিবদের তো খাদ্যের পিছনেই আয়ের সিংহভাগ ব্যয় হয়ে যায়। তাঁরা শিল্পপণ্য কিনবেন কী করে? অতিমারির ফলে মধ্যবিত্ত বিরাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারও আয় কমে গিয়েছে, কারও চাকরিটাই চলে গিয়েছে। তাই আশঙ্কা, কর ছাড় দিয়ে বা অন্য কোনও উপায়ে মধ্যবিত্তের আয় একটু না বাড়ালে অর্থনীতির চাকাটাই ঘুরতে শুরু করবে না।
কেউ বলতে পারেন, সরকারি বিনিয়োগ বাড়লে তো সরাসরি কর্মসংস্থান বাড়বে এবং সেখান থেকে একটা চাহিদা তৈরি হতেই পারে। পারে না, তা নয়। কিন্তু সরকারি বিনিয়োগ রূপায়ণে যেহেতু সময় লাগে, তাই এই প্রক্রিয়ায় চাহিদা বাড়তেও সময় লাগবে। অত দিন অপেক্ষা করার সময় আমাদের আছে কি?
লেখক: অর্থনীতিবিদ