এ ভাবেই বন্দুক নিয়ে ঘুরে বেড়াল বন্দিরা।
বারুইপুরের পর এ বার দমদম কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার। প্রায় সাত ঘণ্টা ধরে গোটা সংশোধনাগার চত্বরে তাণ্ডব চালালেন বিচারাধীন বন্দিদের একাংশ। বলিউডের ছবির ঢঙে দেখা গেল দু’হাতে রিভলভার উঁচিয়ে সংশোধানাগারের মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বিচারাধীন বন্দি। পাশে দাউ দাউ করে জ্বলছে বন্দিদের থাকার একটি ওয়ার্ড। আর এই বিক্ষুব্ধ বন্দিদের তাড়া খেয়ে তখন সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের ওয়ার্ডে প্রাণভয়ে লুকিয়ে রয়েছেন জেলকর্মী এবং আধিকারিকরা!
শনিবার দমদম কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের এই বন্দি-তাণ্ডব এবং তার পর পুলিশ-বন্দি সংঘর্ষের ছবি দেখে চমকে গিয়েছেন কারা দফতরের অনেক কর্তাই। তাঁদের এক জন বলেন, ‘‘জেলের দেওয়ালে বা গেটে গুলির চিহ্ন রয়েছে। মোটা ইস্পাতের দরজা ফুটো করে দিয়েছে বুলেট। বিভিন্ন জায়গায় পড়ে বুলেটের খোল। বুলেট প্রুফ ভেস্ট পরনে পুলিশ জেলে ঢুকছে পরিস্থিতি সামাল দিতে। যেন জেল নয়, যুদ্ধক্ষেত্র। এ রকম ছবি এ রাজ্যের কোনও সংশোধনাগারে আগে দেখিনি।”
বাস্তবেই এ দিন দমদম কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের সংঘর্ষ এবং তাণ্ডবকে বেনজির বলে মনে করছেন খোদ কারা কর্তারাই। বিকেল পাঁচটা নাগাদ শেষ পর্যন্ত জেল চত্বরে ঢুকে বিক্ষুব্ধ বন্দিদের ওয়ার্ডে ঢুকিয়ে পরিস্থিতি কোনও মতে নিয়ন্ত্রণে আনে পুলিশ। তখনও বন্দিদের লাগানো আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে ওয়ার্ডে।
গোটা দিনের তাণ্ডব নিয়ে বলতে গিয়ে শিউরে ওঠেন এক কারারক্ষী। তাঁর কথায়, ‘‘এ দিনের গন্ডগোল যে যথেষ্ট পরিকল্পনা করে, তা আমরা প্রথমে বুঝতে পারিনি। শুরুতে বিক্ষোভের কারণ ছিল, কেন পরিবারের সঙ্গে দেখা করা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে? জেল সুপার নিজে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, করোনাভাইরাস যাতে বন্দিদের মধ্যে না ছড়ায় তার জন্যই সাময়িক ভাবে সাক্ষাৎ বন্ধ করা হয়েছে।” ওই জেল রক্ষী বলেন, ‘‘এতে বিপত্তি হয়। বন্দিদের একাংশ সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের মতো প্যারোল দাবি করেন।” আর তার পরই ওয়ার্ডের গেট ভাঙার চেষ্টা শুরু হয়। জেল কর্মীদের দাবি, প্রথমে জেলরক্ষী এবং ওয়ার্ডাররা বিচারাধীন বন্দিদের ২/১ ওয়ার্ডে হাল্কা লাঠিচার্জ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে চেষ্টা করেন। কিন্তু অনেক বেশি তৈরি ছিলেন বন্দিরা। পাল্টা তাঁরা ঘিরে ফেলেন জেল রক্ষীদের।
র্যাফ নামালেও প্রাথমিক পরিস্থিতি সামলাতে ব্যর্থ জেল আধিকারিকরা।
সূত্রের খবর, ওই পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত হয়ে কয়েক জন জেলরক্ষী আগ্নেয়াস্ত্র বার করে বন্দিদের ভয় দেখাতে যান। আর তখনই বন্দিরা সেই অস্ত্র ছিনতাই করে নেন। যদিও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় এক বিচারাধীন বন্দির দাবি, জেলরক্ষীরা আতঙ্কিত হয়ে গুলি চালান এবং তাতে আহত হন দু’ই বন্দি। আর তাতেই আগুনে ঘি পড়ে।
আরও পড়ুন: কোথায় কোয়রান্টিন? বিদেশ থেকে ফিরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন পুলিশ কর্তার ছেলে
জেল সূত্রে জানা গিয়েছে, এর পরেই মারমুখী বন্দিরা ধারালো অস্ত্র জোগাড় করে পাল্টা কারারক্ষীদের তাড়া শুরু করেন। তত ক্ষণে দমদম থানা থেকে পুলিশ এবং র্যাফ এলেও সংখ্যায় অনেক বেশি থাকা সশস্ত্র বন্দিদের মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হন তাঁরা।
ইতিমধ্যে জেলের দখল নিয়ে নেয় বন্দিরা। জেলের মূল ফটক ভিতর থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয় যাতে, বাইরে থেকে অতিরিক্ত বাহিনী ঢুকতে না পারে। জেলের রান্নাঘর থেকে গ্যাস সিলিন্ডার বের করে ২/১ থেকে ২/২০ পর্যন্ত ওয়ার্ডে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। ৩ নম্বর ভবনের একাংশের আগুন লাগানো হয় বলে সূত্রের খবর। শুরু হয় ভাঙচুর। জেলের অফিস থেকে শুরু করে হাসপাতালে চলে এলোপাথাড়ি ভাঙচুর। এক জেল কর্মী বলেন, ‘‘জেলের মধ্যে বিভিন্ন কাজ করার ব্যবস্থা রয়েছে বন্দিদের। তার জন্য যে কোদাল, কুড়ুল, দা, হাঁসুয়া মজুত থাকে সেগুলোই তালা ভেঙে নিয়ে নেন বন্দিরা।”
আরও পড়ুন: ‘জনতা কার্ফু’, কাল ট্রেন-বাস-মেট্রো পরিষেবা কেমন থাকবে? দেখে নিন
তত ক্ষণে প্রাণ ভয়ে সাজাপ্রাপ্তদের ওয়ার্ডে আশ্রয় নিয়েছেন জেলার এবং কারারক্ষীরা। এক কারারক্ষী বলেন, ‘‘দেখতে পাই জেলের পাঁচিলের বাইরে যে দিকে কারা কর্মীদের কোয়ার্টার্স, সে দিকে মই লাগিয়ে পাঁচিল টপকাচ্ছেন অনেক বন্দি। আমরা অসহায়। ক’জন পালিয়েছেন তা-ও জানি না।” অন্য এক কারা রক্ষী বলেন, ‘‘সামনের মাঠে তখন বন্দিদের জটলা। তার মধ্যে হলুদ টি শার্ট পরা, মাথায় সাদা তোয়ালে এক বন্দির দু’হাতে দুটো রিভলভার দেখতে পেলাম। সিনেমার কায়দায় বন্দুক উঁচিয়ে আমাদের গালিগালাজ করছেন।”
বাইরে থেকে পুলিশ ঢুকতে গেলেই ইটবৃষ্টি শুরু হয়। পুলিশের একাংশের অভিযোগ, তারা ঢোকার চেষ্টা করলে ভিতর থেকে বন্দিরা গুলিও চালায়। তত ক্ষণে ঘটনাস্থলে হাজির রাজ্যের দুই মন্ত্রী সুজিত বসু এবং জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। ঘটনাস্থলে রয়েছেন ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের কমিশনার মনোজ বর্মা থেকে শুরু করে সব শীর্ষ কর্তাই। এর মধ্যেই পুলিশ শূন্যে গুলি চালানোর নির্দেশ দেয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, পুলিশ জেলের গেট থেকে রাইফেল তাক করে সরাসরি গুলি চালাচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি তেমনই।
বিকেল চারটে থেকে ধীরে ধীরে পুলিশ ভিতরে ঢোকা শুরু করে। মনোজ বর্মা এবং তাঁর দেহরক্ষীকে দেখা যায় বুলেট প্রুফ ভেস্ট পরে ঢুকতে। সন্ধ্যার মুখে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে সাড়ে ৭ নাগাদ সংশোধনাগারে যান কারা মন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাস। এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত জেল কর্তারা বন্দিদের সংখ্যা গুনতে পারেননি। ফলে এখনও স্পষ্ট নয় ক’জন পালিয়েছেন।