তবলার টানে টেমস ছেড়ে গঙ্গার তীরে

হোটেলের চারতলার কোণের ঘরে বিরামহীন তবলা বোল উঠছে ভোর থেকে। আর কোনও কিছুতেই আকর্ষণ নেই ঘরের বাসিন্দাটির। তাঁর জগৎ কেবলই তবলাময়। সেখানে তেহাই, ঠেকা, লগ্‌গি, চক্রদারের উঠান-পড়ন। একতাল তিনতাল ঝাঁপতাল রূপকের বিলম্বিত থেকে চৌদুনে যাতায়াতের লয়কারিতে রাত কাটে, দিন হয়

Advertisement

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় 

নবদ্বীপ  শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৯ ০২:৪১
Share:

তালিম: গুরু সঞ্জীব পালের কাছে তাল শিখছেন বিনোদ কেরাই। নিজস্ব চিত্র

হোটেলের ঘরে তবলার আওয়াজ শুনে চমকে উঠেছিলেন পাশের ঘরের মানুষটি। বড়দিনে নবদ্বীপ বেড়াতে এসে বিষ্ণুপ্রিয়া হল্ট লাগোয়া হোটেলে যাঁরা উঠছেন, তাঁরাই অবাক হচ্ছেন!

Advertisement

হোটেলের চারতলার কোণের ঘরে বিরামহীন তবলা বোল উঠছে ভোর থেকে। আর কোনও কিছুতেই আকর্ষণ নেই ঘরের বাসিন্দাটির। তাঁর জগৎ কেবলই তবলাময়। সেখানে তেহাই, ঠেকা, লগ্‌গি, চক্রদারের উঠান-পড়ন। একতাল তিনতাল ঝাঁপতাল রূপকের বিলম্বিত থেকে চৌদুনে যাতায়াতের লয়কারিতে রাত কাটে, দিন হয়।

হোটেলের ১২ নম্বর ঘরের আশ্চর্য ওই বাসিন্দার নাম বিনোদ কেরাই। নিবাস টেমস-পারের লন্ডন। তবে ডিসেম্বরের গোড়া থেকেই রয়েছেন গঙ্গাতীরে, নবদ্বীপে। উদ্দেশ্য, গুরুর কাছে বসে হাতে-কলমে তবলার কঠিন পাঠ নেওয়া। লন্ডনের এক নামি ব্যাঙ্কের পদস্থ চাকুরে বিনোদ কিছু দিন যাবত খ্যাতনামা তবলা শিল্পী সঞ্জীব পালের কাছে তালিম নিচ্ছেন। কিন্তু বছরভর দেশে-বিদেশে ব্যস্ত থাকার কারণে গুরুর কাছে শিক্ষার বেশিটাই হত স্কাইপের মাধ্যমে। তাতে মন ভরছিল না তবলার প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া বিনোদের। তাঁর ইচ্ছা, গুরুর সামনে বসে লাগাতার তালিম নেবেন। তাই মাস আটেক আগে সঞ্জীব যখন জার্মানিতে ছিলেন, সেখানে গিয়ে কয়েক দিন তালিম নিয়েছেন বিনোদ। সেখানে বসেই ঠিক করে ফেলেন, বড়দিনের ছুটিতে নবদ্বীপে গুরুপাটে গিয়ে নেবেন তালিম।

Advertisement

একবিন্দু বাংলা বলতে বা বুঝতে পারেন না মধ্য চল্লিশের ছিপছিপে বিনোদ। বাবা দেবজিৎ কেরাই আদতে গুজরাতের কচ্ছের বাসিন্দা হলেও এখন পাকাপাকি ভাবে লন্ডনবাসী। বিনোদ এবং তাঁর তিন বোনের জন্মও লন্ডনে। কলেজে পড়তে পড়তে গান-বাজনার প্রতি টান জন্মায় বিনোদের। শুরুতে ঢোল শিখতে শুরু করেন। কিছু দিনের মধ্যে আঙুলের সমস্যায় চিকিৎসকের পরামর্শে বাজনা বন্ধ করে দিতে হয়। ডাক্তার বলেছিলেন, তাঁর আর্থারাইটিস হয়েছে। তিনি আর কোনও দিন কিছু বাজাতে পারবেন না। লম্বা সময় কেটে যায় তালহীন, সুরহীন। ইতিমধ্যে চাকরিতেও ঢুকে পড়েন বিনোদ। তাঁর নিজের কথায়, “অফিসের কাজের চাপে আমি এক সময় মানসিক রোগী হয়ে উঠেছিলাম। সারা দিন মাথায় শুধু অফিস ঘুরত। ভাবছিলাম, এ ভাবে আর বেশি দিন বাঁচব না। সেই সময় ভারতীয় সঙ্গীত আমাকে নতুন করে জীবনে ফিরতে সাহায্য করে।”

বিনোদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু জোনাথন মায়ার একজন নামি সেতারবাদক। প্রয়াত সেতারবাদক, পণ্ডিত সুব্রত রায়চৌধুরীর সঙ্গে তবলা বাজাতেন সঞ্জীব পাল। জোনাথন ছিলেন সুব্রতর শিষ্য। তিনিই বন্ধুকে পরামর্শ দেন, সঞ্জীবের কাছে তালিম নেওয়ার। তালবাদ্যের প্রতি প্রবল ঝোঁকের কারণে এবার বিনোদ বেছে নিয়েছেন তবলা। তবে তবলাকে ভালোবাসার জন্য যথেষ্ট মূল্য দিতে হতে পারে সাগরপারের এই বাসিন্দাকে।

বিনোদ বলেন, “আমি যখন অফিসে জানাই যে আমি দীর্ঘ সময়ের জন্য ভারতে যাব গানবাজনা শিখতে, ওরা ছুটি দিতে রাজি হয়নি। তবে আমার স্ত্রী হানসা আমায় ভীষণ সাহস জুগিয়েছে। ও নিজেও ব্যাঙ্কে চাকরি করে। বলেছে, আমি আছি, তুমি যাও। জানি না আদৌ আমার আর চাকরি আছে কি না।”

তবে তাতে কোন আফশোস নেই খাঁটি সাহেবি চেহারার বিনোদের। দিনে আট ঘণ্টা রেওয়াজ করছেন। নবদ্বীপে তথা গুরুর কাছে আবার ফিরবেন পরের শীতে, তা-ও আগাম জানিয়ে দিলেন। সঞ্জীব বলেন, “এমন নিষ্ঠাবান ছাত্র পেয়ে আমি গর্বিত।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement