Communal harmony

communal harmony: উদয়ন মাস্টারের দোয়ায় ভালবাসার দেশ

দুর্গাপুরের একটি ম্যানেজমেন্ট স্কুলে বিজ়নেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের শিক্ষক উদয়ন মৈত্র হিন্দু না মুসলিম, তা নিয়েই কারও কারও বেজায় ধন্দ।

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৬:৫২
Share:

ইসলামি নাথ শরিফ গাইছেন উদয়ন মৈত্র। নিজস্ব চিত্র।

সে এক মগজধোলাইয়ের দেশে তাঁর ছাত্রদের মুক্ত, স্বাধীন স্বর হয়ে বাঁচার শিক্ষা দিয়েছিলেন সত্যজিতের সিনেমার উদয়ন পণ্ডিত। ২০২২-এর ভারতবর্ষে ঘৃণার উল্টো পিঠে যেন এক ভালবাসার দেশ গড়ছেন অন্য উদয়ন।

Advertisement

দুর্গাপুরের একটি ম্যানেজমেন্ট স্কুলে বিজ়নেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের শিক্ষক উদয়ন মৈত্র হিন্দু না মুসলিম, তা নিয়েই কারও কারও বেজায় ধন্দ। ঘৃণার চশমার আতসকাচে যাঁরা দেখেন, তাঁরা রটিয়ে বেড়ান, ব্যাটা বামুনের ছেলে লুকিয়ে ধর্ম পাল্টেছে! কেউ বলে লোকটার এত মুসলিম-প্রীতির নেপথ্যে কোনও গোপন প্রেমের ব্যথা বা কুমতলব। মধ্য চল্লিশের উদয়ন আহত হন, তাঁর স্ত্রী, মা, বাবা এমনকি আট বছরের ছেলেটাকেও ক্ষুদ্রমনাদের কটূক্তি সইতে হচ্ছে। সংস্কৃতে পিএইচডি উদয়নের স্ত্রী শুভশ্রী দৃঢ় স্বরে বরকে এ সবে মাথা ঘামাতে বারণ করেছেন। তিনিও বোঝেন, অভিন্নহৃদয় মুসলিম বন্ধু, দাদা, বোন বা প্রবীণ অভিভাবকদের ভালবাসার দুর্গেই উদয়ন বন্দি।

গত আড়াই দশক ধরে রেড রোডে রোজা শেষের ইদের নমাজে কামাই নেই দুর্গাপুরের ব্রাহ্মণসন্তান শিক্ষকের। কাকভোরে খিদিরপুর, হেস্টিংসের বন্ধুদের ঘুমও ভাঙান, ফজরের নমাজ আদায় না-করলে কিন্তু ইদের নমাজ কবুল হবে না! উর্দু, আরবি পড়তে পারেন না। তবে ইদের নমাজের নিয়ত বাঁধা (সঙ্কল্প মন্ত্র) বা কেউ মারা গেলে উচ্চারণের দোয়াটুকু উদয়নের কণ্ঠস্থ। আল্লার অজস্র বন্দনাগীতি ‘নাথ শরিফ’ শোনাতে তাঁর ডাক পড়ে বিভিন্ন ধর্মীয় আসর বা মিলাদে। আবার বাড়িতে লক্ষ্মী, সত্যনারায়ণ পুজোতেও উদয়ন স্বচ্ছন্দ। সরস্বতী পুজো, দুর্গাপুজোর অঞ্জলিতেও যান খোলা মনেই। হেসে বলেন, “ধর্ম পাল্টানোর ইচ্ছে নেই। কিন্তু আমি মনেপ্রাণে মুসলিমও। এক সঙ্গে দু’টো ধর্ম মেনে চলাটা আমার কাছে সহজ ও স্বাভাবিক বলেই মনে হয়।”

Advertisement

আজ, ভালবাসার দিনের আগে থেকেই বন্ধুদের টানে পার্ক সার্কাস ময়দানে সংখ্যালঘু উন্নয়ন মন্ত্রকের মিলনমেলা-য় টানা পড়ে আছেন উদয়ন। সন্ধ্যায় ‘পড়শিকে জানুন’ বলে একটি নাগরিক মঞ্চের স্টলে রুমালে মাথা ঢেকে সশ্রদ্ধ ভঙ্গিতে উদাত্ত স্বরে ‘নাথ’ ধরলেন উদয়ন। হজযাত্রীদের গান, কাফিলা জব মদিনে কো জানে লাগা…! নিখাদ ভালবাসার স্বরে হিন্দু, মুসলিম সব বন্ধুরই তখন চোখ চিকচিক করছে।

এই বাংলায় নিরামিষভোজী জগন্নাথ-গবেষক বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক শেখ মকবুল ইসলামের কথা অনেকে জানেন। কিন্তু সংখ্যাগুরু সমাজে চিরকালের ‘অপর’ বলে চিহ্নিত মুসলিমদের সংস্কৃতি বিষয়ে অজ্ঞতার ছবিটাই ইদানীং প্রকট। সেখানে রাজ্য হজ কমিটির স্বেচ্ছাসেবী বা দুর্গাপুরে স্থানীয় মুসলিমদের সমিতিতে ঠাঁই পাওয়া উদয়নের আন্তরিক সংবেদনশীলতা, সহমর্মিতা এক চিরন্তন ভারতবর্ষের ঘরানা বলেই দেখেন তাঁর
মুসলিম বন্ধুরা।

মাতৃসমা লতা মঙ্গেশকরের প্রয়াণের পরে দোয়া পড়ে রীতি মেনে শাহরুখ খানের ফুঁ নিয়েও সদ্য হাজারো অপব্যাখ্যা হয়েছে। হিজাবের দোহাই পেড়ে মুসলিম ছাত্রীদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করার অপচেষ্টাও দেখা যাচ্ছে। অনেকের কাছে, এই ঘৃণার ভারতের উল্টোপিঠে, উদয়ন বা তাঁর বন্ধুরা এক ভালবাসার ভারতের মুখ।

কৈশোরে হেস্টিংসে সরকারি আবাসনে পেশায় আমলা পিসেমশাইয়ের বাড়িতে ঘন ঘন আসা-যাওয়ার সূত্রেই এক ধরনের পাঁচমিশেলি সংস্কৃতির ছোঁয়াচ তাঁর জীবনে। খিদে পেলে বরাবর পিতৃপ্রতিম আলমগির চাচা (ক্যালকাটা মাদ্রাসা আলিয়া কলেজিয়েট স্কুলের প্রধানশিক্ষক) বা প্রাণের বন্ধু আসিফের বাড়িতে চেয়ে খেয়েছেন। উদয়নের কথায়, “বাড়িতে বিফ ছাড়া কিছু না-থাকলেও ওঁরা সঙ্গে-সঙ্গে অন্য কিছু রেঁধে খাইয়েছেন।” ছেলের মুসলিমদের সঙ্গে মেলামেশার নানা রটনায় উদয়নের মা একটু চিন্তায় পড়েছিলেন। পরে সব বুঝে ইদের আগে ছেলের কুর্তা, পাজামা নিজে ইস্ত্রি করে দিতেন। এ ছেলের বিয়েতে হই হই করে বাসে দুর্গাপুরে গিয়েছিলেন ২৫০ মুসলিম বরযাত্রী। লশকর লেন মসজিদের ইমাম থেকে উঁচুতলার সরকারি কর্তা তানভির আফজল, মহম্মদ রিজওয়ান কে ছিল না! উদয়ন মাস্টার বলেন, “বিফ নিয়ে আমার প্রতি মুসলিম বন্ধুদের সহৃদয়তা মনে রেখে আমরাও মেনুতে হালাল চিকেন, মাটনই রেখেছিলাম! এবং আমার স্ত্রী পাশে না-থাকলে কখনওই এই সংস্কৃতির চর্চা ধরে রাখতে
পারতাম না!”

সবার রঙে রং মেশানো ভালবাসার ভারতই শেষ কথাটা বলে চলে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement