বাঁ দিকে, নাতনিকে কোলে নিয়ে সুষমা। সঙ্গে অঙ্কিতা ও সতীশ। ডান দিকে, গৌতম, রাহুল এবং পৌলোমী। নিজস্ব চিত্র
দু’টো আলাদা জীবনের গল্প।
এক জন ২৬ বছরের এক তরুণীর মা, অন্য জন ২৯ বছরের এক যুবকের বাবা। পিতৃত্ব বা মাতৃত্ব বলতে সন্তান যা বোঝে, অসুস্থতার কারণে ওঁরা কেউই সেই দায়িত্ব পালন করে উঠতে পারেননি। জীবনের বড় অংশ ওঁদের কেটেছে মানসিক হাসপাতালের অন্ধকারে। কোভিড পরিস্থিতিতে যেখানে প্রিয়জনকেও অতি সহজে দূরে ঠেলছে মানুষ, সেখানে দীর্ঘকাল মানসিক হাসপাতালে থাকতে বাধ্য হওয়া বাবা-মাকে সসম্মানে নিজেদের কাছে নিয়ে গেলেন দুই নবীন। জন্মের পরিচয়টুকু বাদ দিয়ে যাঁদের মধ্যে এত বছর কোনও বন্ধনই তৈরি হয়নি!
কলকাতার পাভলভ হাসপাতালে চলতি সপ্তাহের একই দিনে দু’টি সম্পূর্ণ আলাদা পরিবারের এ ভাবে মিলে যাওয়ার ঘটনা এই অস্থির সময়ে অনেকখানি আলোর বার্তা বয়ে আনল বলে মনে করছেন অনেকেই।
কলকাতার টালিগঞ্জের বাসিন্দা অঙ্কিতার কাছে মায়ের কোনও স্মৃতিই নেই। দেওঘরের বর্ধিষ্ণু পরিবারের এই তরুণীর মা সুষমা ছিলেন মানসিক ভাবে অসুস্থ। মাঝেমধ্যেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেন তিনি। আবার ফিরেও আসতেন। বহু বছর আগে এক বার বেরিয়ে গিয়ে আর ফেরেননি। নানা জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছন কলকাতায়। মানসিক ভারসাম্যহীন সুষমাকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করে পুলিশ। দীর্ঘ চিকিৎসার পরে সুস্থ হয়ে ওঠা সুষমা বছর দেড়েক আগে জানাতে পেরেছিলেন তাঁর বাড়ির হদিশ। সেই অনুযায়ী পাভলভ হাসপাতাল থেকে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতিনিধি অনিন্দিতা চক্রবর্তী দেওঘরে তাঁর শ্বশুরবাড়িতে যান। কিন্তু স্বামী-সহ শ্বশুরবাড়ির লোকেরা জানিয়ে দেন, সুষমা তাঁদের কাছে মৃত। তাই ফেরত নেওয়ার প্রশ্নই নেই। বিবাহসূত্রে কলকাতায় থাকা অঙ্কিতার কাছে এই খবর পৌঁছয় কয়েক মাস পরে। তার পর থেকেই মাকে ফেরাতে উদ্যোগী হন তিনি ও তাঁর স্বামী সতীশ। অঙ্কিতা জানান, মা যখন বাড়ি ছেড়েছিলেন, তখন তাঁর বয়স ছিল এক বছর। এখন ২৬। বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর আগে। তাঁদের মেয়ের বয়স আড়াই বছর। বিয়ের পরে তিনি স্নাতক হয়েছেন। এখন বি এড করছেন— সবটাই সতীশের উৎসাহে। মাকে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে সতীশই তাঁকে ভরসা জুগিয়েছেন সবচেয়ে বেশি।
আরও পড়ুন: কোভিডে মৃতার দেহ নীচে নামাতেই দাবি সাড়ে চার হাজার!
সতীশ বলেন, ‘‘এটা নিয়ে কথা বলার কী আছে? নিজের পরিবারের মানুষকে ফিরিয়ে নেব, সেটাই তো স্বাভাবিক। সব জেনেও চুপ করে থাকলে নিজের সন্তানের কাছে ভবিষ্যতে মুখ দেখাতে পারতাম?’’ মেয়ের দু’কামরার ছোট্ট ফ্ল্যাটের একটা ঘর এখন সুষমার। অন্ধকারের দীর্ঘ জীবন কাটিয়ে এমন একটা নিটোল সংসার যে তাঁর নিজের হয়ে উঠবে, সে কথা এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না ওই প্রৌঢ়ার।
ঠিক যে ভাবে পুত্র, পুত্রবধূ ও তিন বছরের নাতিকে নিয়ে নতুন জীবন এখনও অবিশ্বাস্য গৌতম মুখোপাধ্যায়ের কাছে। ছত্তীসগঢ়ের রায়পুরের একটি স্কুলের চাকুরে রাহুল মুখোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রী পাভলভ থেকে গৌতমবাবুকে নিয়ে যাচ্ছেন নিজেদের সংসারে। গত বেশ কয়েক বছর পাভলভের বাসিন্দা গৌতমবাবুর জীবন ঘটনাবহুল। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়। দ্বিতীয় বিয়ে করেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গেও বিচ্ছেদ হয়ে যায়। মোটা বেতনের চাকরি করেছেন, কিন্তু সঞ্চয় না করে সবই খরচ করেছেন বিভিন্ন শখ মেটাতে। অসুস্থ হওয়ার পরে কয়েক জন আত্মীয় তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করে যান। সুস্থ হওয়ার পরেও কেউ ফেরত না নেওয়ায় হাসপাতালেই কার্যত বন্দি থাকতে বাধ্য হচ্ছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন: করোনার থাবা মস্তিষ্কে? মার্কিন গবেষণায় শঙ্কা
প্রথম স্ত্রীর ঠিকানা পেয়ে হাসপাতাল থেকে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি জানান, প্রাক্তন স্বামীর দায়িত্ব নেওয়ার মতো অবস্থা তাঁর নেই। প্রথম বিয়ের সূত্রে সম্তান হয়েছিল তাঁদের। দীর্ঘদিন যোগাযোগ না থাকলেও সেই পুত্রকে অবশ্য বাবার খবর দেন মা। আশৈশব পরিবারের স্নেহ-ভালবাসা থেকে বঞ্চিত সেই ছেলেই পাভলভে যোগাযোগ করে বাবাকে ফিরিয়ে নিতে উদ্যোগী হয়েছেন। এই মানসিক জোর পেলেন কোথা থেকে? রাহুল বলেন, ‘‘পরিবারটা ভেঙে গিয়েছিল। আমি স্বপ্ন দেখছি সবটা জোড়া লাগানোর। বাবাকে নিয়ে যাচ্ছি। চেষ্টা করছি ভবিষ্যতে মাকেও নিয়ে যাওয়ার। তা হলে সবাই একসঙ্গে থাকব। আমার সন্তান সবাইকে নিয়ে বাঁচতে শিখবে। বাবা হিসেবে এর চেয়ে বেশি চাওয়া আর কী হতে পারে?’’ রাহুলের এই সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশি সমর্থন জুগিয়েছেন তাঁর স্ত্রী পৌলোমী।
যে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে দুই পরিবারে এমন পুনর্মিলন, সেই সংগঠনের তরফে শুক্লা দাস বড়ুয়া বলেন, ‘‘পরিবারে বা সমাজে সবাই তো এক রকম হয় না। কিন্তু একরকম না হলেই তাঁকে ফেলে দিতে হবে, এটাও কোনও যুক্তি নয়। আমরা বরাবর মনোরোগীদের ক্ষেত্রেও এই ‘থিয়োরি অব ইনক্লুশন’-এর কথাই বলে এসেছি। ওই দুই পরিবার বাস্তবে সেটাকেই সত্যি করে তুলল।’’
সমাজকর্মী রত্নাবলী রায়ের মতে, ‘‘এই অস্থির সময়ে পারিবারিক মূল্যবোধই বেশি প্রাসঙ্গিক। একে অন্যের সঙ্গে মানসিক ভাবে বেঁধে বেঁধে থাকার প্রবণতা যদি অতিমারির মধ্যেও কিছুটা আশা জাগায়, তা হলে সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি, মানসিক রোগীদের নিয়ে সমাজের মানসিকতাও যে বদলাচ্ছে, এই দুই ঘটনায় সেটাও প্রমাণ হল।’’
ভরসা থাকুক!