কৃষ্ণনগর সংশোধনাগারের দায়িত্ব নিলেন মহিলা জেল সুপার।
সাহিত্য থেকে সিনেমা— সংশোধনাগারের সর্বোচ্চ পদাধিকারীর চরিত্রে কোনও মহিলাকে দেখা গিয়েছে, এ দেশে এমন উদাহরণ চটজলদি মনে পড়া দুষ্কর। সে বাংলার ‘লৌহকপাট’ হোক বা হিন্দির ‘আরাধনা’। কিন্তু বিরল সেই ঘটনাই করোনা-পর্বে এই রাজ্যে ঘটে গিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের দু’টি সংশোধনাগারের সুপারের পদে এসেছেন দুই নারী। এ ছাড়া, একটি মহিলা সংশোধনাগারের দায়িত্বে এক মহিলা সুপার ছিলেনই। সব মিলিয়ে তিনটি জেলের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন তিন মহিলা আধিকারিক।
উঁচু পাঁচিল আর গরাদের ঘেরাটোপে দিন গুজরান করা মানুষগুলো হয় অভিযুক্ত, নয় সাজাপ্রাপ্ত আসামি। তাঁদের রোজকার ভাল-মন্দ, জীবনযাপন— সবই দেখাশোনা করতে হয় সংশোধনাগার কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু সে সব ‘ঝক্কির কাজ’ করতে পারবেন তো মহিলারা? ঊর্ধ্বতন অফিসার হিসেবে সবাই কি তাঁদের মেনে নিতে পারবেন? যোগ্যতার মাপকাঠিতে মহিলারা ‘পাশ’ করলেও এমন সাত-পাঁচ প্রশ্ন আর সংশয় কিন্তু এখনও রয়েছে। কারা দফতরের অন্দরে কান পাতলেও তা শোনা যায়। পরিস্থিতি তাই অনুকূল হয়নি এত দিন। সংশোধনাগার বা দফতরের অন্য কাজ সামলে মহিলাদের পদোন্নতি হলেও ‘সুপার’ পদে তাঁদের সচরাচর দেখা যায়নি। বরং খাতা-কলমের কাজেই যেন সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা।
কোভিড অতিমারির প্রভাবে নানা চিরাচরিত প্রথা-ভাবনায় ছেদ পড়ছে। কাকতালীয় ভাবে, সেই সময়েই নতুন পথে হাঁটার ইঙ্গিত দিল রাজ্যের কারা দফতর। কৃষ্ণনগর জেলা সংশোধনাগারের সুপারের পদে এলেন পৃথা সিংহ। আসানসোল বিশেষ সংশোধনাগারের সুপার হলেন অমৃতা মণ্ডল। আলিপুর মহিলা সংশোধনাগারে সুপারের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন শকুন্তলা সেন। এঁরা ছাড়া দমদম কেন্দ্রীয় ও প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারে দু’জন করে মহিলা ডেপুটি জেলার রয়েছেন। এক জন করে মহিলা ডেপুটি জেলার রয়েছেন আলিপুর মহিলা সংশোধনাগার ও বর্ধমান কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে। দু’জন জেলার রয়েছেন আলিপুর মহিলা সংশোধনাগারে। সব মিলিয়ে রাজ্যের সংশোধনাগারে এখন মহিলাদের ‘আধিকারিক একাদশ’।
প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারের ডেপুটি সুপার হিসেবে বছর তিনেক আগে কারা দফতরে কর্মজীবন শুরু পৃথার। প্রেসিডেন্সি থেকে কৃষ্ণনগর জেলা সংশোধনাগারের সুপার হয়ে এসেছেন মার্চে। সুবিধে-অসুবিধে মিলিয়েই সামলাচ্ছেন গুরুদায়িত্ব। পৃথার কথায়, ‘‘এক জন পুরুষ যে ভাবে পরিস্থিতি অনুযায়ী সব কিছু সামলান, এক জন মহিলাও সে ভাবেই তাঁর দায়িত্ব পালন করেন। প্রত্যেকের কাজ করার পদ্ধতি আলাদা।’’ দমদম, প্রেসিডেন্সি, আলিপুর, বারুইপুরে জেলার হিসাবে দায়িত্ব সামলে সপ্তাহ কয়েক আগে আসানসোলের বিশেষ সংশোধনাগারের সুপার হওয়া অমৃতার মতে, ‘‘আলাদা করে নারী-পুরুষের ফারাক নেই। সবাই মানুষ।’’ মহিলারাও যে রাত-দিন এক করে সীমান্ত পাহারা দিচ্ছেন, তা মনে করিয়ে দিচ্ছেন অমৃতা। তাঁর দাদা বর্তমানে কারা দফতরের পদস্থ আধিকারিক। বাবার কর্মজগৎও ছিল একই। বাবা-দাদার কর্মজীবন কি বাড়তি উৎসাহ দিয়েছে? অমৃতা বলছেন, ‘‘তা হয়তো কাকতালীয়।’’
আলিপুর মহিলা সংশোধনাগারের সুপার শকুন্তলা কিন্তু মনে করেন, মহিলাদের এমন পদে নিয়োগের সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গির বদলের কোনও সম্পর্ক নেই। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আগে এই ধরনের চাকরিতে মেয়েরা কম আসতেন। এখন বেশি আসছেন, তাই কাজের সুযোগও বেশি হচ্ছে। এর সঙ্গে মিথের কোনও সম্পর্ক নেই।’’ তা সত্ত্বেও মহিলা ‘বস’-এর সঙ্গে পুরুষ কর্মী-আধিকারিকেরা অসহযোগিতা করছেন কি না, সে দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে বাধ্য হচ্ছেন কারা-কর্তারা। তাঁদেরই অনেকে বলছেন, ‘‘পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে এখনও কি আমরা সবাই বেরোতে পেরেছি!’’