করোনাভাইরাসের নজিরবিহীন এবং ভয়াবহ সংক্রমণের সময় পরপর দুই বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গ— সাগরমেলা এবং বইমেলা।
করোনাভাইরাসের নজিরবিহীন এবং ভয়াবহ সংক্রমণের সময় পরপর দুই বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গ— সাগরমেলা এবং বইমেলা। দু’টিতেই লক্ষ লক্ষ লোকের সমাগম হয় প্রতি বছর। প্রশাসনিক রিপোর্ট অনুযায়ী, গঙ্গাসাগরে সাতদিনে কমবেশি ৩০ লক্ষ লোকের সমাগম হয়। তবে পাশাপাশিই প্রশাসনের একাংশের বক্তব্য, ওই হিসেব খানিকটা অতিরঞ্জিতও হতে পারে। কিন্তু সাতদিনে যে লক্ষ লক্ষ লোক গঙ্গাসাগরে আসেন, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
আদালতের নির্দেশে আগামী ১০ জানুয়ারি থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার সাগরদ্বীপে সাগরমেলা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই অনেকে সেখানে পৌঁছে গিয়েছেন। স্নানও শুরু হয়েছে। আগামী ১৪ জানুয়ারি সাগরে মকরসংক্রান্তির পুণ্যস্নান। সেদিনই সাগরদ্বীপে সর্বাধিক লোকসমাগমের সম্ভাবনা। ঘটনাচক্রে, শনিবার ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, তাঁর লোকসভা কেন্দ্র এলাকায় আগামী দু’মাস কোনও রাজনৈতিক সমাবেশ হবে না। কোনও বড় পুজো বা ধর্মীয় সমাবেশও হবে না। অভিষেক বলেন, ‘‘আদালতের নির্দেশ মেনেই গঙ্গাসাগর মেলা হবে।’’
আগামী ৩১ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়ার কথা বইমেলা। চলবে প্রায় দু’সপ্তাহ। সেই মেলার প্রস্তুতির কাজও জারি রেখেছেন উদ্যোক্তারা। বইমেলায় ১২ দিনে ২৪ লক্ষের মতো জনসমাগম হয় বলেই অতীতের প্রশাসনিক রিপোর্ট বলছে। অর্থাৎ, প্রতিদিন ২ লক্ষ! করোনার সংক্রমণ যে অবস্থায় পৌঁছেছে, তাতে ভইমেলায় যদি সত্যিই একদিনে ২ লক্ষ লোকের সমাগম হয়, তা হলে পরিস্থিতি যে আরও ভয়াবহ হবে, তাতে সন্দেহ নেই।
যে ভাবে বইমেলার প্রস্তুতি হচ্ছে, সাগরমেলার প্রস্তুতিও ঠিক সে ভাবেই জারি থেকেছিল। যদিও চিকিৎসকদের একাংশ প্রথম থেকেই সাগরমেলার আয়োজন নিয়ে তাঁদের আপত্তি জানাতে শুরু করেছিলেন। রাজ্য সরকার অবশ্য প্রথম থেকেই কোভিড সুরক্ষাবিধি মেনে মেলা করার পক্ষপাতী ছিল। শেষপর্যন্ত একজন চিকিৎসক মেলা বন্ধের দাবি জানিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেন।
শুনানির পর শুক্রবার সে বিষয়ে রায় দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। যাতে শর্তসাপেক্ষে মেলা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। নজরদারির জন্য একটি তিন সদস্যের কমিটিও গড়ে দেওয়া হয়েছে। যেখানে থাকবেন রাজ্যের প্রতিনিধি, রাজ্যের বিরোধী দলনেতা বা তাঁর কোনও প্রতিনিধি এবং রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বা তাঁর কোনও প্রতিনিধি।
যদিও মানবাধিকার সংগঠনগুলি কমিটি নিয়ে ইতিমধ্যেই আপত্তি তুলতে শুরু করেছে। মানবাধিকার কর্মী রঞ্জিৎ শূরের কথায়, ‘‘রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ এখন শূন্য। রাজ্য সরকার যাঁকে মনোনীত করেছে, তাঁর আদেশনামায় রাজ্যপাল বা বিরোধী দলনেতা সাক্ষর করেননি। কোনও দায়িত্বপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানও নেই। ফলে কোনও প্রতিনিধি নিয়োগ করারও প্রশ্ন নেই।’’ পাশাপাশিই তাঁর সংশয়, ‘‘বিরোধী দলনেতাও নিশ্চয়ই রাজ্য সরকারের দিকে সহায়তার হাত বাড়াবেন না। তা হলে কমিটিতে থাকবেন একমাত্র রাজ্য সরকারের প্রতিনিধি। তিনি কি নিজের কাজে নিজে নজরদারি করবেন? বলা হয়েছে, তিন সদস্যের কমিটিতে সমণ্বয় করবেন রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের সচিব। কিন্তু সে পদও এখন শূন্য!’’
বইমেলা নিয়ে রাজ্য সরকার এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। নবান্ন সূত্রের খবর, গঙ্গাসাগর মেলার ফলাফল দেখে নিয়ে ওই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। কিন্তু ততদিন বা ততক্ষণ সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্কে মেলার প্রস্তুতি পুরোদমেই চালানো হচ্ছে। স্টল বুকিং-সহ যাবতীয় প্রস্তুতি ইতিমধ্যেই সারা হয়ে গিয়েছে। ফলে উদ্যোক্তারা ধরেই নিচ্ছেন, বইমেলা হবে।
সম্প্রতি কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলার উদ্যোক্তা ‘পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড’-এর তরফে ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় আনন্দবাজার অনলাইনকে সরাসরিই বলেছিলেন, ‘‘দিদি (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) যা চাইবেন, সেটাই হবে। আমরা আমাদের কাজ চালু রেখেছি। আমরা সরকারি নির্দেশের অপেক্ষায় থাকব। রাজ্য সরকার যা নির্দেশ দেবে, সেটাই আমরা মানব।’’
প্রসঙ্গত, গতবছর কোভিডের কারণে কলকাতা বইমেলা হয়নি। এ বার তাই জোরকদমে মেলার প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল। বস্তুত, কলকাতা বইমেলার আগে জেলায় জেলায় বইমেলাও শুরু হয়েছিল। কয়েকটি জেলায় মেলা হওয়ার পরেই রাজ্যে ভয়াবহ কোভিড-স্ফীতি দেখা দেয়। তার প্রেক্ষিতে কয়েকটি জেলা বইমেলা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
এখন দেখার, কলকাতা বইমেলা সম্পর্কে কী সিদ্ধান্ত নেয় নবান্ন। নাকি তার ফয়সালাও করতে হবে আদালতকেই!