রাত বাড়তেই শব্দ-তাণ্ডব, জোড়া প্রাণ নিল তুবড়ি

কালীপুজোর আলোয় আলোকময় শহর দেখতে দেখতে ঠাকুরমার হাত ধরে রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা নাগাদ বেহালার শীলপাড়ায় হাঁটছিল আদি। রাস্তায় তুবড়ি ফাটানো হচ্ছিল। আচমকাই একটি তুবড়ি ফেটে খোলের একাংশ ছিটকে এসে লাগল তার গলায়। ঢলে পড়ল সে।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৯ ০৪:১১
Share:

বাজির বলি: আদি দাস

সন্ধ্যার দিকে বোমা, পটকা, শেলের দাপট তুলনায় কিছুটা কম ছিল। কিন্তু রাত বাড়তেই ঘুম ভেঙে জেগে উঠল শব্দদানব! কলকাতার দুই প্রান্তে তুবড়ি ফেটে প্রাণ গেল একটি শিশু এবং এক যুবকের। মৃতদের নাম আদি দাস (৫) এবং দীপকুমার কোলে (৪০)।

Advertisement

কালীপুজোর আলোয় আলোকময় শহর দেখতে দেখতে ঠাকুরমার হাত ধরে রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা নাগাদ বেহালার শীলপাড়ায় হাঁটছিল আদি। রাস্তায় তুবড়ি ফাটানো হচ্ছিল। আচমকাই একটি তুবড়ি ফেটে খোলের একাংশ ছিটকে এসে লাগল তার গলায়। ঢলে পড়ল সে। নিয়ে যাওয়া হল বিদ্যাসাগর হাসপাতালে। সেখানেই মৃত্যু হয় তার।

পুলিশ জানায়, আদিদের বাড়ি শীলপাড়াতেই। তুবড়ির খোলের টুকরোটি এসে গলায় লাগায় গুরুতর আহত হয় সে। আত্মীয়স্বজন জানান, আদির গলায় ঢুকে যাওয়া তুবড়ির টুকরোটি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বার করলেও শেষরক্ষা হয়নি। স্থানীয় সূত্রের খবর, বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ছিল আদি। রাতে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, আদির বাবা কাজল দাস আর্তনাদ করছেন। প্রায় প্রলাপের মতো করে বলছেন, ‘‘ওর কাছে (আদি তখন মর্গে) রাতে কে থাকবে?’’ শোকে নিথর নিকটজনেরা তাঁকে ঘিরে আছেন। এক আত্মীয় জানান, অগস্টে পাঁচ বছর পূর্ণ করেছিল আদি।

Advertisement

দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, পোড়া রংমশাল এবং অন্যান্য বাজি পড়ে রয়েছে। রাস্তায় লেগে আছে রক্ত। পুলিশ আধিকারিকেরা তার নমুনা সংগ্রহ করেন। এলাকার কিছু বাসিন্দাকে জিজ্ঞাসাবাদও করেন তাঁরা। পুলিশ জানায়, কে বা কারা ওখানে তুবড়ি ফাটাচ্ছিল, বাসিন্দারা সেই বিষয়ে মুখ খুলতে চাইছেন না। বস্তুত, শীলপাড়ায় এত বাজি পোড়ানো হচ্ছিল যে, ধোঁয়ায় ঢেকে যায় ওই অঞ্চলের বহু এলাকা।

কসবা উত্তরপাড়ায় দীপকুমার সন্ধ্যায় নিজেই তুবড়ি জ্বালাচ্ছিলেন বলে জানায় পুলিশ। একটি তুবড়ি ফেটে যাওয়ায় খোলের একাংশ বিঁধে যায় তাঁর গলায়। শুরু হয় রক্তক্ষরণ। শিশুমঙ্গল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়। দীপবাবুরা তিন ভাই। দীপবাবু অবিবাহিত। তাঁর বৃদ্ধা মা কালীপুজো উপলক্ষে বাপের বাড়ি গিয়েছেন। আজ, সোমবার তাঁর ফেরার কথা। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে দীপবাবুদের বাড়ি যান মেয়র-পারিষদ সুশান্ত ঘোষ। দীপবাবুর দুই দাদার সঙ্গে ফোনে কথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কান্নায় ভেঙে পড়েন দুই দাদা।

পুলিশি সূত্রের খবর, তুবড়ি ফেটে দু’জনের মৃত্যুর খবর শুনে রাতেই পুলিশ কমিশনার অনুজ শর্মার সঙ্গে কথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী। এমন তুবড়ি কোথা থেকে আসছে, তা তৈরিতে গলদ-গাফিলতি থাকছে কি না, সেই সব বিষয়ে সবিস্তার তথ্য জোগাড় করার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।

তুবড়ি নিষিদ্ধ বাজি নয়। কিন্তু অনেক সময়েই এই বাজির খোল ফেটে যায়। যদিও সেই খোল ফেটে এমন প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার কথা সাম্প্রতিক কালে মহানগর বা অন্যত্র শোনা যায়নি। রাতে বেহালায় গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন গলি ও রাস্তায় দেদার বাজি ফাটানো চলছে। রাস্তায় রাস্তায় ফাটানো হচ্ছে তুবড়িও।

শব্দবাজির মোকাবিলায় এ বার ব্যাপক প্রস্তুতি, নজরদারি ও টহল চলছে দাবি করছিল পুলিশ। কিন্তু রাত বাড়তেই বাজির তাণ্ডব বাড়তে থাকে খাস কলকাতায়। কেষ্টপুর-সহ উপকণ্ঠের বিভিন্ন এলাকায় সন্ধ্যা থেকেই বাজির দাপট চলছিল। রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ বেহালায় দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল, যেন যুদ্ধের ময়দান! প্রতি সেকেন্ডে অন্তত একটি বোমা ফাটছে। হরিদেবপুর এলাকাতেও শব্দবাজি ফেটেছে বিস্তর। রাতে বিসি রায় শিশু হাসপাতালে প্রচণ্ড শব্দবাজি ফাটানোর অভিযোগ পেয়ে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রতিনিধি এবং পরিবেশকর্মীরা সেখানে যান। পরিবেশকর্মীদের যৌথ সংগঠন সবুজ মঞ্চ জানায়, ভবানীপুর এলাকা থেকেও হাসপাতালের কাছে, লখার মাঠে বাজি ফাটার অভিযোগ এসেছে। সবুজ মঞ্চের কাছে রাত ১১টা পর্যন্ত ৭৮টি অভিযোগ জমা পড়ে। মাইক ও ডিজে বক্স নিয়েও প্রচুর অভিযোগ এসেছে বলে জানান সংগঠনের সম্পাদক নব দত্ত। তিনি বলেন, ‘‘গত কয়েক বছর মাইক ও ডিজে নিয়ে অভিযোগ কম ছিল।’’ সন্ধ্যা থেকে ডিজে-র দাপটে অতিষ্ঠ ছিল মধ্যমগ্রাম-সহ উত্তর শহরতলি।

পর্ষদ জানায়, তারাও কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রচুর অভিযোগ পেয়েছে। বাজি পোড়ানোর সময়সীমা (রাত ৮টা-১০টা) নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকাও মানা হয়নি। অভিযোগ বেশি বরাহনগর, বেহালা, হরিদেবপুরে। ইএম বাইপাস সংলগ্ন প্রগতি ময়দান, ধাপা, কসবা, সল্টলেকেও দেদার শব্দবাজি ফেটেছে। একই অভিযোগ আসে রিজেন্ট পার্ক, নেতাজিনগর, গাঙ্গুলিবাগান থেকে। পর্ষদের রাত ১২টার তথ্য বলছে, যাদবপুর, বিধাননগর-সহ বিভিন্ন জায়গায় বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার (পিএম ২.৫) মাত্রা ৫০০ (দিল্লির সমান) ছুঁয়েছে।

রাত বাড়তেই শব্দবাজির দাপট বাড়ে শিলিগুড়িতেও। সকাল থেকে মুর্শিদাবাদের বহরমপুর, কান্দি, লালবাগ, লালগোলা, ফরাক্কাতেও রাত কেঁপেছে সেই বাজির দাপটে। আসানসোল ও দুর্গাপুরেও যথেচ্ছ শব্দবাজি ফেটেছে। তবে হুগলিতে শব্দবাজির দাপট ছিল অনেকটাই কম। তার জন্য পুলিশ, প্রশাসন এবং নাগরিক সংগঠনের অভিযানকে কৃতিত্ব দিচ্ছেন নাগরিকেরা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement