সারদা কেলেঙ্কারিতে ‘ত্রিনেত্র কনসালট্যান্ট প্রাইভেট লিমিটেডে’র রহস্যময় ভূমিকার তদন্ত করতে গিয়ে উঠে এসেছিল ‘ত্রিলোক অ্যাডভাইসরি প্রাইভেট লিমিটেড’ নামে আরও একটি সংস্থার নাম। কোম্পানি নিবন্ধকের (রেজিস্ট্রার অব কোম্পানিজ বা আরওসি) নথি ঘেঁটে ইডি-র তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন যে, ‘ত্রিনেত্র’ শুরুর সময় যিনি অন্যতম ডিরেক্টর ছিলেন, সেই মনোতোষ যাদব ‘ত্রিলোক’-এরও ডিরেক্টর। সংস্থাটি ২০১১ ও ২০১২ সালে মোট সাড়ে পাঁচ কোটি টাকার ছবি কিনেছে। সেই ছবি কার আঁকা জানা না-থাকলেও যে হেতু সারদা কেলেঙ্কারিতে বারবার ছবির প্রসঙ্গ উঠে আসছে, তাই এ ব্যাপারে খোঁজখবর শুরু করেছেন ইডি-র গোয়েন্দারা।
কোম্পানি নিবন্ধকের খাতায় ‘ত্রিলোক’-এর ঠিকানা দেওয়া আছে বালিগঞ্জ প্লেসের একটি বাড়ির দোতলার একটি ফ্ল্যাট। যদিও সংস্থার কাগজপত্রে ঠিকানা লেখা কিরণশঙ্কর রায় রোডের একটি অফিস বাড়ি। বালিগঞ্জ প্লেসের ঠিকানায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে সংস্থার নামে ঘর ভাড়া নেওয়া থাকলেও সেটি দীর্ঘদিন ধরেই তালাবন্দি। লিলুয়ায় মনোতোষ যাদবের বাড়ি গিয়েও তাঁর দেখা পাওয়া যায়নি। এর আগে ‘ত্রিনেত্র’ সংস্থাটি নিয়ে শোরগোলের সময়ও মনোতোষ যাদবের খোঁজ পাওয়া যায়নি। ইডি-র তদন্তকারীদের কাছেও তিনি অধরা। আরও আশ্চর্যের হল, ‘ত্রিলোক’-এর অডিটরেরও খোঁজ মিলছে না। সংস্থার ব্যালান্স শিটে অডিটরের অফিসের যে ঠিকানা লেখা রয়েছে, সেখানে গিয়ে তার তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। অডিট রিপোর্টে উল্লেখ থাকা ফোন নম্বরেও সাড়া মেলেনি অডিটরের!
‘ত্রিনেত্র’-র অডিট রিপোর্ট নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। প্রথমত, রিপোর্ট দেখে গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, এক-এক বছরে অডিটরের সই এক-এক রকম। এর পরেই অডিটর হিসেবে যাঁর নাম আছে, সেই রবিকুমার ভট্টর তাঁর সই ও রবার স্ট্যাম্প জাল করা হয়েছে বলে পুলিশে অভিযোগ করেছেন। দ্বিতীয়ত, ‘ত্রিনেত্র’-র দুই ডিরেক্টর মনোজকুমার শর্মা ও শশীকান্ত দাসের খোঁজ মিলছে না।
‘ত্রিনেত্র’-র পরে ‘ত্রিলোক’-এর ক্ষেত্রেও প্রায় একই রকম প্রশ্ন ওঠায় বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখছেন ইডি-র গোয়েন্দারা। তাঁরা জানাচ্ছেন, ২০১০-’১১ আর্থিক বছরে ‘ত্রিলোক’ ৫০ লক্ষ টাকায় দু’টি ছবি কিনেছিল। এর পরের বছর পাঁচটি ছবি কিনতে তারা খরচ করে পাঁচ কোটি টাকা। অথচ, ডিরেক্টরদের রিপোর্ট বলছে ওই বছরে সংস্থার আয় শূন্য এবং ক্ষতির পরিমাণ ১ লক্ষ ৪৫ হাজার ৭৬৭ টাকা! লোকসানে চলা একটা সংস্থা কার, কোন ছবি কেনার পিছনে কেন এত টাকা খরচ করল, সেটাই ভাবাচ্ছে গোয়েন্দাদের। এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য সংস্থার ব্যালান্স শিটে নেই। গোয়েন্দাদের একাংশের প্রশ্ন, তৃণমূলের তরফেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি কারা কিনেছেন, তার তালিকা দেওয়া হয়নি। তবে কি ছবির সূত্রে ‘ত্রিলোক’-এর সঙ্গে তৃণমূলের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রয়েছে? যদিও অন্য এক তদন্তকারীর কথায়, ‘‘শাসক দলের সঙ্গে ত্রিলোকের সম্পর্ক রয়েছে কি না, সে ব্যাপারে এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’
‘ত্রিলোক’-এর ব্যাপারে খোঁজ নিতে আনন্দবাজারের তরফে তাদের বালিগঞ্জ প্লেসের ঠিকানায় গিয়ে কাউকে না-পেয়ে সংস্থার অডিটর ‘সুলতানিয়া উমেশ অ্যান্ড কোম্পানি’র সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। ‘ত্রিলোক’-এর জমা দেওয়া অডিট রিপোর্ট অনুসারে সুলতানিয়া উমেশ অ্যান্ড কোম্পানির মালিকের নাম উমেশকুমার সুলতানিয়া। ঠিকানা গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউ। এ দিন সেখানে গিয়ে দেখা গেল, বাড়ির একতলায় গেটের মুখে বসে রয়েছেন মাঝবয়সী এক নিরাপত্তারক্ষী। সুলতানিয়া প্রসঙ্গ তুলতেই বললেন, ‘‘এখানে ওই অফিস থাকলে তো পাবেন!’’ তাঁর দাবি, বছর দেড়েক ধরে ওই বাড়িতে কাজ করছেন, কিন্তু সুলতানিয়া নামে কোনও সংস্থার নাম শোনেননি! আগেও এমন কোনও সংস্থা এই বাড়িতে ছিল কি না, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে ওই রক্ষীর। তা হলে কি রবিকুমারের মতো উমেশেরও সই জাল করা হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সংস্থার প্যাডে ছাপা তাঁর মোবাইলে ফোন করা হয়েছিল। কিন্তু সে ফোনের লাইনই মেলেনি!
কিন্তু ‘ত্রিলোক’-এর মতো একটি সংস্থার ছবি কেনার উপরে কেন এত গুরুত্ব দিচ্ছেন গোয়েন্দারা? বিশেষ করে যখন তারা কার আঁকা ছবি কিনেছে, সেটা জানা নেই? ইডি-সূত্রের বক্তব্য, এর একটা কারণ ত্রিনেত্র-র প্রতিষ্ঠাতা ডিরেক্টর ও ‘ত্রিলোক’-এর ডিরেক্টর একই লোক। ‘ত্রিনেত্র’-র থেকে তৃণমূল যে ১ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা নিয়েছিল, তা এখন স্পষ্ট। দলের অডিট রিপোর্টেই তার উল্লেখ আছে। এ বছরের গোড়ায় তৃণমূলের তৎকালীন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় নির্বাচন কমিশনকে চিঠিতে জানান, ত্রিনেত্র-র থেকে পাওয়া টাকা প্রথমে অনুদান মনে হলেও পরে জানা গিয়েছে ওটা ঋণ। তাই আগের হিসেবে সংশোধন করা হোক। ‘ত্রিনেত্র’-র সূত্র ধরে ‘ত্রিলোক’-এর সঙ্গেও তৃণমূলের যোগাযোগ রয়েছে কি না, খতিয়ে দেখা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত গোয়েন্দারা বলছেন, তৃণমূলের হিসেবে ছবি বিক্রি করে সাড়ে ছয় কোটি টাকা আয়ের কথা বলা হয়েছে। (যদিও মমতা শুক্রবার এক জনসভায় দাবি করেন, তাঁর ছবি বিক্রি করে দলের মুখপত্রের আয়ের পরিমাণ দু’কোটি টাকা।) ‘ত্রিলোক’-এর হিসেব বলছে, ছবি কেনা খাতে তাদের খরচ সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা। দু’টি অঙ্ক কাছাকাছি হওয়ায় কোনও ঝুঁকি না-নিয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
তৃণমূল, ত্রিনেত্র, ত্রিলোক— কোনও ত্র্যহস্পর্শ কি না, সেটাই আপাতত ইডি-র তদন্তজালে।