আকাশ শর্মা ও নুসরত জাহান। —নিজস্ব চিত্র।
এ রাজ্যে সরকারি হাসপাতালে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলের জন্য সব ‘ফ্রি’ (নিখরচায় চিকিৎসা)। ওয়ার্ডে শয্যা ফ্রি। ডাক্তার দেখানো ফ্রি। পরীক্ষানিরীক্ষা ফ্রি। অস্ত্রোপচার ফ্রি। ওষুধও ফ্রি। অথচ অন্য অনেক রাজ্যের থেকে ফ্রি-তে এগিয়ে থাকা স্বাস্থ্য পরিষেবার এই ‘স্বর্গরাজ্যে’ প্রতি বছর কয়েকশো ক্যানসার আক্রান্ত শিশু মারা যাচ্ছে শুধুমাত্র চিকিৎসা শেষ করতে না পেরে।
পৃথিবী জুড়ে যত শিশু ক্যানসারে আক্রান্ত হয়, তাদের ৯০ শতাংশেরই সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার কথা। কারণ, শিশুদের ক্ষেত্রে মাত্র ১০ শতাংশ ক্যানসার এমন, যা সারে না। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, এ রাজ্যে ক্যানসার আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশই মারা যায় বিনা চিকিৎসায় কিংবা চিকিৎসা শেষ করতে না পেরে।
সরকারি হাসপাতালে সব ফ্রি হওয়া সত্ত্বেও কেন থমকে যাচ্ছে শিশুদের চিকিৎসা? কোথায় আটকাচ্ছে তাদের নিয়মিত ‘ফলোআপ’? উত্তর খোঁজার জন্য কয়েকটা উদাহরণই হয়তো যথেষ্ট।
নদিয়ার কল্যাণীর বাসিন্দা আকাশ শর্মা এখন আট। আকাশের বাবা সাজন স্থানীয় একটি গ্যারাজে মিস্ত্রির কাজ করেন। মাসে আয় মেরেকেটে ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা। ২০২০ থেকে অসুস্থ আকাশ। বাবার কাজের সূত্রে আগে সপরিবারে বিহারের দ্বারভাঙায় থাকত তারা। ঘন ঘন গলা ব্যথা আর জ্বরের সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু হয়েছিল। রোগ ধরা প়ড়ছিল না। সাজন ও স্ত্রী রীণা সিদ্ধান্ত নেন, নিজেদের রাজ্যে ফিরবেন তাঁরা। সেই মতো কল্যাণীর বাড়িতে এসে ছেলেকে নিয়ে যাওয়া হয় জে এন এম হাসপাতালে। ১০ দিন ভর্তি থাকে আকাশ। ডাক্তাররা বলেন, লিভারের সমস্যা। কলকাতায় রেফার করেন তাঁরা। কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আনা হয় তাকে। সেখান থেকে রেফার করা হয় এসএসকেএমে।
২০২১-এর মার্চে এসএসকেএমে ভর্তি হয় আকাশ। ক্যানসার ধরা পড়ে। হজকিন্স লিম্ফোমা। তার পরে মাস ছয়েক হাসপাতালে ভর্তি। ১৮টা কেমো। ২০টা রেডিয়েশন। সাজন বললেন, ‘‘শরীরে কয়েকখানা হাড় ছাড়া আর কিছু ছিল না ওর। ডাক্তারবাবুরা বলেছিলেন, ছেলেটা সেরে যাবে। কিন্তু নিয়মিত এসে দেখাতে হবে। এক-এক বার ছেলেকে নিয়ে কলকাতায় আসা, সকলের খাওয়াদাওয়া, সব মিলিয়ে ৫০০-৬০০ টাকা খরচ। আরও দু’টো বাচ্চা আছে আমাদের। তাদের কী খাওয়াব? তাই ডাক্তারবাবুরা যেমন বলেন, তেমন সব সময় মানতে পারি না। কপালে যা আছে তা-ই হবে।"
মুর্শিদাবাদের শিবনগর গ্রামের নুসরত জাহানের রক্তের ক্যানসার ধরা পড়েছিল গত বছরের নভেম্বরে। জেলা হাসপাতালে চিকিৎসা হয়নি। মেয়েকে নিয়ে আসতে হয়েছিল কলকাতায়। স্বামী কেরলে শ্রমিকের কাজ করেন। ন’বছরের নুসরতের মা শিউলি খাতুনের উপরেই দায়িত্ব দুই সন্তানের।
শিউলি বললেন, “ডাক্তারেরা এক মাস অন্তর দেখাতে বলেছেন। কিন্তু প্রতি মাসে গাড়ি ভাড়া খরচ করে যাতায়াতের সামর্থ্য কোথায়? যে দিন যাই, সে দিন সব মিটিয়ে রাতে ফেরা হয় না। থাকার ব্যবস্থা করতে হয়। আর শহরে তো জলটুকুও বিনা পয়সায় নেই। অত টাকা পাব কোথায়?’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘হাসপাতালে সবই ফ্রি। তবে মাঝে-মাঝে কিছু দামি ওষুধ কিনতে হয়েছে। মেয়ের তিনটে ওষুধ কিনে দিতে হয়েছিল। এক-একটা ওষুধের দাম ৪৮০০ টাকা। দেনা করে কিনেছিলাম। সেই দেনাই শোধ হয়নি। গরিব ঘরের মেয়ের এমন রোগ হলে, কপাল ছাড়া ভরসা নেই।’’
কলকাতার সরকারি হাসপাতালে দীর্ঘ সময় শিশুদের ক্যানসার চিকিৎসা করেছেন হেমাটোলজিস্ট প্রান্তর চক্রবর্তী। অধুনা এ রাজ্য ছেড়ে অন্য রাজ্যে প্রান্তিক মানুষের চিকিৎসা শুরু করা প্রান্তর বলছিলেন, “২৫০-৩০০ কিলোমিটার দূর থেকে মানুষ রুগ্ণ সন্তানকে নিয়ে কলকাতায় আসেন চিকিৎসার জন্য। ট্রেনে ক্যানসার রোগীর টিকিট ফ্রি। কিন্তু অনেকের পক্ষে ট্রেনে না এসে দূরপাল্লার বাসে আসা সুবিধাজনক। বাস ফ্রি নয়। বেশি অসুস্থ হলে অ্যাম্বুল্যান্স। সরকারি ভাবে তার কোনও ব্যবস্থা নেই। তাই অ্যাম্বুল্যান্সের টাকা জোগাড় করতে ঘটিবাটি বিক্রির জোগাড় হয়। আর যদি ট্রেনে আসেন, তা হলেও প্রত্যন্ত এলাকার বাড়ি থেকে স্টেশনে পৌঁছনোর গাড়িভাড়া অনেকের থাকে না। আর ট্রেনে ফ্রি পরিষেবা পাওয়ার জন্য একটা ফর্ম পূরণ করাতে হয় সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে। বহু জায়গায় সেই ফর্ম পূরণ করার মতো কেউ থাকেন না বলে তাঁরা সেই সুবিধাটুকুও পান না।”
দারিদ্রসীমার নীচে থাকা রোগীদের আর্থিক সাহায্যের জন্য ত্রিপুরা, কেরল, হরিয়ানায় ‘ক্যানসার পেনশন’ চালু হয়েছিল বেশ কিছু বছর আগেই। পঞ্জাব এবং হরিয়ানায় ক্যানসার রোগীদের জন্য বাসভাড়া ফ্রি। ফলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চিকিৎসার জন্য যাতায়াতে অনেকটাই সুবিধা পান রোগীরা।
“এখানে ক্লাবকে অনুদান, লক্ষ্মীর ভান্ডার ইত্যাদিতে স্রোতের মতো টাকা ভাসানোর পরে এগুলো ভাবার অবকাশ মেলে না। অথচ ক্যানসার আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসার আনুষঙ্গিক খরচের জন্য একটা তহবিল গড়লে, বহু শিশু বেঁচে যেতে পারত। কারণ, অনেক গরিব পরিবারেই চিকিৎসার জন্য শহরে আসার অর্থ সেই দিনগুলোর রোজগার বন্ধ থাকা। এক সন্তানের জন্য সেটা করলে, অন্য সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেওয়া যাবে না। অসহায় বাবা-মা কোন দিকে যাবেন?” বলছিলেন এসএসকেএমের এক চিকিৎসক।
ক্যানসার-আক্রান্ত শিশুদের জন্য কলকাতার এসএসকেএম এবং এনআরএসে হেল্প ডেস্ক চালু করেছে ‘লাইফ বিয়ন্ড ক্যানসার’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। পরিবারের কাউন্সেলিংয়ের পাশাপাশি যে সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা সরকারি হাসপাতালে হয় না, যে সব ওষুধ সেখানে পাওয়া যায় না, তার অন্তত কিছুটা ব্যবস্থার চেষ্টা করছে এই সংগঠন। সংগঠনের অন্যতম কর্মকর্তা পার্থ সরকারও বললেন, “স্রেফ গাড়িভাড়া জোগাড় করতে না পেরে কত শিশুর চিকিৎসা বন্ধ হয়ে গেছে। গণ পরিবহণে ক্যানসার রোগী ও তাদের বাড়ির অন্তত এক জন লোকের ভাড়া যদি মকুব হত, তা হলে সুস্থতার হার আরও বাড়তে পারত।”
এক দিকে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্যের দাবি, অন্য দিকে মাঝপথে চিকিৎসাছুট অসংখ্য শিশু, যাদের অধিকাংশেরই পরে আর কোনও হদিস মেলে না। গাড়িভাড়া জোগাড় করতে না পেরে, দামি ওষুধের টাকা জোগাড় করতে না পেরে, দৈনিক রোজগার বন্ধ রেখে শহরে আসতে না পেরে, ফলোআপ চিকিৎসার প্রয়োজনিয়তা উপলব্ধি করতে না পেরে বহু পরিবার চিরতরে হারিয়ে ফেলে তাদের সন্তানকে।
স্বাস্থ্য দফতরের প্রাক্তন কর্তা, একদা দুঁদে এক সরকারি আমলার কথায়, “চিকিৎসা শুরু করেও তা মাঝপথে বন্ধ হয় বহু রোগের ক্ষেত্রেই। কিন্তু ক্যানসার-আক্রান্ত শিশুদের বিষয়টা আলাদা। যেখানে ১০০ জনের মধ্যে ৯০ জনেরই সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফেরার কথা, সেখানে এক জনও যদি চিকিৎসা চালাতে না পেরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়, তা হলে সেই ব্যর্থতার দায় আমরা অস্বীকার করতে পারি না।”
প্রশ্ন হল, রাজ্য জুড়ে পরিষেবার এমন ‘বাড়বাড়ন্তের’ মধ্যেও শহরে ছুটে আসার প্রয়োজন পড়ছে কেন এখনও?