ভাবাচ্ছে নির্বাচন কমিশন

ভারতীকে সরিয়েও স্বস্তি নেই শাসকের

জঙ্গলমহলের এক জেলা থেকে তাঁর বদলি হয়ে গিয়েছে। তবে নতুন পদেও তাঁর কাজের পরিধি সেই জঙ্গলমহলই। ভোটের মুখে ভারতী ঘোষকে নিয়ে সেটাই এখন মাথাব্যথা শাসকদলের। সৌজন্যে নির্বাচন কমিশন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:৪৮
Share:

ভারতী ঘোষ। ফাইল চিত্র।

জঙ্গলমহলের এক জেলা থেকে তাঁর বদলি হয়ে গিয়েছে। তবে নতুন পদেও তাঁর কাজের পরিধি সেই জঙ্গলমহলই। ভোটের মুখে ভারতী ঘোষকে নিয়ে সেটাই এখন মাথাব্যথা শাসকদলের। সৌজন্যে নির্বাচন কমিশন।

Advertisement

পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার পদ থেকে বদলি হয়ে ভারতীদেবী এখন মাওবাদী দমনে নিযুক্ত বিশেষ বাহিনীর (এলডব্লিউই অপারেশনস্‌) অফিসার অন স্পেশ্যাল ডিউটি। সংক্ষেপে ‘ওএসডি’।

স্থানীয় তৃণমূলের একাংশ আড়ালে স্বীকার করছেন, পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রামের এসপি পদে থাকাকালীন ভারতীদেবীর ‘ফিল্ডওয়ার্ক’-এর জন্য গত চার বছর জঙ্গলমহলে বিরোধিহীন স্বস্তির আবহ ছিল। ভোটের বিজ্ঞপ্তি জারি হওয়ার আগেই তাই নির্বাচন কমিশনের নজরে থাকা এই আইপিএস অফিসারকে পশ্চিম মেদিনীপুরের এসপি এবং ঝাড়গ্রামের ভারপ্রাপ্ত এসপি পদ থেকে সরিয়ে মাওবাদী দমনে গঠিত বিশেষ বাহিনীর মাথায় বসিয়েছে রাজ্য সরকার।

Advertisement

বিরোধীদের অভিযোগ, ভারতীকে নতুন পদের দায়িত্ব দিয়ে জঙ্গলমহলের বিধানসভা আসনগুলিতে জয়ের পথ সুনিশ্চিত করতে চাইছে শাসক দল। সেই কারণেই তড়িঘড়ি একটি বাহিনী তৈরি করে ভারতীকে ওএসডি করা হয়েছে। উদ্দেশ্য মাওবাদী দমনের নামে বিরোধীদের দমন।

বিরোধীদের দাবি, কৌশলগত কারণেই গত ২৮ জানুয়ারি বেলপাহাড়ির ভেলাইডিহা অঞ্চল তৃণমূলের সভাপতি জয়রাম টুডুকে মাওবাদী কার্যকলাপের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে ইউএপি আইনের ধারায় মাওলা রুজু করে পুলিশ। উদ্দেশ্য পরিষ্কার, কমিশনকে বলার সুযোগ থাকবে, জঙ্গলমহলে সব দলের মধ্যেই মাওবাদীদের লোকজন রয়েছে। ফলে, ভোটের আগে বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থকদের ধরপাকড় করা যাবে। মুখ্যমন্ত্রীর স্নেহধন্য জঙ্গলমহলের শাসক শিবিরের ভরসা ভারতীকেই যদি কমিশন সরিয়ে দেয়, তাহলে কী হবে!

বারবার বিতর্কে জড়িয়েছেন ভারতী। তাঁর বিরুদ্ধে শাসক তৃণমূলের হয়ে কাজ করার অভিযোগে সোচ্চার হয়েছেন বিরোধীরা। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের সময় নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে ভারতীকে পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রামের এসপি পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ভোটের পর ফের দু’টি পদেই তাঁকে ফেরানো হয়। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে এবং চলতি বছরের জানুয়ারির গোড়ায় মেদিনীপুরে প্রকাশ্য সভায় মুখ্যমন্ত্রীকে ‘জঙ্গলমহলের মা’ সম্বোধন করে বিরোধীদের তোপের মুখে পড়েন ভারতী। গত বছর খড়্গপুর পুরবোর্ড গঠনের সময় ভারতীর পরিকল্পনা মাফিক তৃণমূলের বিরুদ্ধে কাউন্সিলর কেনাবেচার অভিযোগ তোলেন বিরোধীরা। গত বছর জুনে খড়্গপুর পুরবোর্ড গঠনের পর তৃণমূলের খড়্গপুর শহর সভাপতি দেবাশিস চৌধুরীর সঙ্গে করমর্দন করে বিতর্কে জড়িয়েছিলেন ভারতী। নানা সময়ে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের একের পর এক মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে গ্রেফতার করার অভিযোগ ওঠে ভারতীর বিরুদ্ধে। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ফোন করে তৃণমূলে যোগ দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে ভারতীর বিরুদ্ধে। সবং কলেজে ছাত্রপরিষদ কর্মী খুনের মামলার চার্জশিটে মুখ্যমন্ত্রীর দাবি অনুযায়ী, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে খুনের তত্ত্বকে মান্যতা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে ভারতীর বিরুদ্ধে। পিংলায় বিস্ফোরণ কাণ্ডে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন বিয়েবাড়ির জন্য বাজি তৈরি হচ্ছিল। অভিযোগ, ভারতীর অঙ্গুলি হেলনে চার্জশিটে বোমা কারখানার পরিবর্তে বাজি কারখানার কথা বলা হয়।

২ জানুয়ারি ঝাড়গ্রাম পুলিশ জেলার নতুন এসপি-র দায়িত্ব নেন সুখেন্দু হীরা। তিনি ব্যারাকপুরে রাজ্য সশস্ত্র পুলিশের ৬ নম্বর ব্যাটালিয়নের কম্যান্ডান্ট ছিলেন। কিন্তু তারপরও গত ২৪ জানুয়ারি বেলপাহাড়ির চিড়াকুটি গ্রামে পুলিশের জনসংযোগ অনুষ্ঠানে জেলার তৃণমূল নেতাদের মঞ্চে বসিয়ে এলাকার বাসিন্দাদের পোশাক, কম্বল, উপহার বিলোনোর অভিযোগ ওঠে ভারতীর বিরুদ্ধে। ঝাড়গ্রাম পুলিশ জেলার ওই অনুষ্ঠানটির আগাগোড়া দায়িত্বে ছিলেন ভারতী। ২৯ জানুয়ারি পশ্চিম মেদিনীপুরের এসপি পদ থেকে ভারতীর বদলির নির্দেশিকা জারি হয়। ইএফআরের প্রথম ব্যাটালিয়নের কম্যান্ডান্ট ভাদনা বরুণ চন্দ্রশেখরকে পশ্চিম মেদিনীপুরের এসপি পদে পাঠানো হয়। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর জঙ্গলমহল সফরের জন্য (১০-১১ ফেব্রুয়ারি) বদলি প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়। ১৬ ফেব্রুয়ারি বদলি হন ভারতী। এতদিন সিনিয়র আইপিএস পুলিশ অফিসাররা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার এসপি পদের দায়িত্ব সামলেছেন। তবে ভাদনা বরুণ অবশ্য ভারতীর থেকে জুনিয়র ব্যাচের অফিসার। ফলে, ভারতীকে এই নতুন বাহিনীর ওএসডি পদের দায়িত্ব দেওয়া কার্যক্ষেত্রে পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম জেলা পুলিশে তাঁর কর্তৃত্ব ও প্রভাব বজায় রাখারই অঙ্গ বলে পুলিশ মহলের ধারণা।

মঙ্গলবার বেলপাহাড়িতে একটি জল প্রকল্পের উদ্বোধনে এসেছিলেন জনস্বাস্থ্য কারিগরি এবং পঞ্চায়েত ও গ্রমোন্নয়নমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। ভারতী প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “বিস্তারিত কিছু জানি না। এটা মুখ্যমন্ত্রীর দফতর। আমার মন্তব্য করা সমীচীন হবে না। তবে আমরা সবসময়ই নির্বাচন কমিশনকে মেনে চলি।” সিপিএমের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক তরুণ রায় বলেন, “ওই মহিলা সম্পর্কে মন্তব্য করব না। নিরপেক্ষ ভাবে নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচন কমিশন যেমন বুঝবেন পদক্ষেপ করবেন। ” ঝাড়গ্রাম জেলা কংগ্রেস সভাপতি সুব্রত ভট্টাচার্য বলেন, “নির্বাচন অবাধ হলে সেটা তৃণমূলের পক্ষে স্বস্তিদায়ক হবে না বুঝেই বিরোধী দমনে ভারতী ঘোষকে মাঠে নামানো হয়েছে। কমিশনের হস্তক্ষেপ দাবি করেছি।” বিজেপি-র ঝাড়গ্রাম জেলা সভাপতি সুখময় শতপথী বলেন, “ভারতী ঘোষ তৃণমূলের ক্যাডার হিসেবে কাজ করেন। তাঁকে জঙ্গলমহলে রেখে কখনই অবাধ নির্বাচন সম্ভব নয়।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement