প্রশিক্ষণ চলছে ওই তরুণীদের। নিজস্ব চিত্র
বাড়ির বাইরে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে চাকরি করবে মেয়েরা— এমনটা ভাবতেই পারে না তাঁদের পরিবার। সেখানে বিয়ের বয়স হলেই তড়িঘড়ি মেয়েকে পাত্রস্থ করাটাই দস্তুর। এমনকি, বিয়ের নামে পাচার হয়ে যাওয়ার ভূরি ভূরি উদাহরণও রয়েছে ওই সব এলাকায়। সেই সঙ্গে প্রকট লিঙ্গ বৈষম্য। কিন্তু কোভিড এবং আমপানের কারণে এমন পাচার-প্রবণ এলাকা থেকে ১৩ জন তরুণী প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে বাড়ির বাইরে পা রাখলেন। ন্যাশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের আওতায় নার্সিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করতে তিন মাসের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তাঁরা। কয়েক জন ইতিমধ্যে কাজও শুরু করেছেন।
তাঁদেরই এক জন বছর উনিশের রুকসানা খাতুন। মগরাহাটের বাসিন্দা রুকসানার বাবা পেশায় দর্জি। কিন্তু শ্বাসকষ্টের কারণে এখন আর কাজ করতে পারেন না। অন্যের জমিতে কাজ করে সংসার টানেন মা। পাঁচ বোনের এক জন রুকসানা পারিবারিক
কারণেই এ বছর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসতে পারেননি। আগামী বছর পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতির ফাঁকে সংসারের হাল ধরতে নার্সিং অ্যাসিস্ট্যান্টের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তিনি। মুর্শিদা খাতুনের বাড়িতেও বাবা-মা ছাড়া রয়েছে দুই বোন এবং এক ভাই। মগরাহাট-নামখানার তাজমিনা খাতুন, সাগরিকা মান্না, তনুজা, সুষমার মতো মোট ১৩ জন তরুণী (যাঁদের বয়স ১৮ থেকে ২৩-এর মধ্যে) দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করতেই এই প্রশিক্ষণ নিয়ে চাকরির পথে পা বাড়িয়েছেন।
আরও খবর: সোমবার বোলপুরে মুখ্যমন্ত্রী, রোড শো মঙ্গলবার, থিমে রবীন্দ্রভাবনা
আরও খবর: রাজ্যে দৈনিক মৃত্যু ও সংক্রমণের হার কমল, কলকাতায় আক্রান্তের সংখ্যায় ফের উদ্বেগ
এই মেয়েদের সামনে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ অবশ্য এনে দিয়েছে কোভিড আর আমপানের তাণ্ডব। ওই এলাকায় শিশুদের নিয়ে কাজ করা এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাছে লকডাউনের সময়ে খবর আসে যে, সেখানে প্রায় প্রতিটি পরিবারই তাঁদের মেয়েদের তড়িঘড়ি পাত্রস্থ করতে চাইছে। ওই সমস্ত এলাকায় বিয়ের নামে নারী পাচার প্রায়ই ঘটে থাকে। ফলে এ কথা জানতে পেরে ওই মেয়েদের স্বাবলম্বী করার কথা ভাবে ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সংস্থাটির তরফে হিমালিনি বর্মা জানাচ্ছেন, ওই এলাকার মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে লাগানোর জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয় চিকিৎসক শতদল সাহার কাছে। প্রান্তিক এলাকার ছেলেমেয়েদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ করে থাকে শতদলবাবুর সংগঠন। সেই মতো বারুইপুরে ১৩ জন তরুণীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে তারা। তবে ছ’মাসের প্রশিক্ষণ শেষ করা হয় তিন মাসে। হিমালিনির কথায়, “প্রতিদিন বাড়ি থেকে আসতে গেলে হয়ত ওরা আসতই না। তাই বারুইপুরেই ঘর ভাড়া নিয়ে সকলের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।” তার পরে বারুইপুর হাসপাতালে ইন্টার্নশিপ।
তবে জীবনের চেনা ছক থেকে মেয়েদের বার করে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজটা খুব সহজ ছিল না। প্রশিক্ষণ শুরুর আগে ওই ১৩ জন তরুণীর পরিবার এবং প্রতিবেশীরাই বাধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। অনেক বুঝিয়ে শেষ পর্যন্ত তাঁদের রাজি করানো যায়। নার্সিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে তিন মাসের প্রশিক্ষণ ও ৪৫ দিনের ইন্টার্নশিপ শেষ করে আজ ওই তরুণীদের কেউ কাজে যোগ দেওয়ার অপেক্ষায়, কেউ আবার ইতিমধ্যেই কাজে যোগ দিয়েছেন।
প্রশিক্ষণ নিয়ে কতটা আত্মবিশ্বাসী ওই তরুণীরা? রুকসানার কথায়, “এক সপ্তাহ হল বারুইপুরের এক বেসরকারি হাসপাতালে কাজে ঢুকেছি। আইসিইউয়ে কাজ করছি। আট ঘণ্টার ডিউটি শেষে বাড়ি গিয়ে রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করি। উচ্চ মাধ্যমিকটা সামনের বছর দিতেই হবে। কাজটা পেয়েছি, এ বার মাকে সাহায্য করতে পারব।” নিজের উপরে আস্থা বেড়ে যাওয়ার কথা বলছেন তাজমিনাও। তাঁর কথায়, “আগে কোথাও গিয়ে কাজ করতে পারব কখনও ভাবিইনি। আর এখন রোগীর সেবা করছি।”
এই তরুণীদের প্রশিক্ষণ নিতে সাহায্য করা, চিকিৎসক শতদলবাবু বলছেন, “ইতিমধ্যেই ন’জন বারুইপুরের এক বেসরকারি হাসপাতালে কাজে ঢুকেছেন। বাকি চার জনকে ইন্টারভিড নেওয়ার জন্য ডেকেছে রাজারহাটের এক বেসরকারি ক্যানসার হাসপাতাল। আশা করছি, সকলেই চাকরি পাবেন।’’