জেএনএনইউআরএম বাসের বকেয়া ঋণের টাকা আদায় করতে সরকারের নয়া হাতিয়ার পোস্ট ডেটেড চেক। যে সব বাসমালিক ঋণের কিস্তির টাকা মেটাচ্ছিলেন না, তাঁদের বাসগুলি আটক করে নিজেরাই চালানোর পরিকল্পনা নিয়েছিল সরকার। চাপে পড়ে বেশ কিছু বাসমালিক বাস ছেড়ে দিতে চাওয়ায় এ বার পোস্ট-ডেটেড চেকে ঋণ শোধের শর্তে বাস ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য পরিবহণ দফতর। ঠিক হয়েছে, বাসমালিকেরা ১২ হাজার টাকা করে আগামী ১২ মাসের চেক দিলে তবেই মিলবে বাস। সরকারের ওই শর্ত মেনে নিতে রাজি বাসমালিকেরা। যদিও তাঁদের বক্তব্য, বাধ্য হয়েই তাঁরা এই শর্ত মানছেন। কারণ, আটক হওয়া বাসগুলি পড়ে নষ্ট হচ্ছিল। পুরো বিষয়টি নিয়ে অবিলম্বে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বারস্থ হওয়ারও আবেদন জানিয়েছেন তাঁরা।
পরিবহণকর্তারা জানাচ্ছেন, কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে ২০০৯-এ ১৫ বছরের পুরনো বাস বসে যায়। বাসের আকাল মেটাতে জেএনএনইউআরএম-এর ৫১২টি বাস কেনে পশ্চিমবঙ্গ পরিবহণ পরিকাঠামো উন্নয়ন নিগম (ডব্লিউবিআইটিডিসি)। ৪৯৬টি বাস বেসরকারি মালিকদের বিলি করা হয়। বাকি ১৬টি দেওয়া হয় দক্ষিণবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ নিগমকে। ৪৯৬টি বাসই রেজিস্ট্রেশন করা হয় ডব্লিউবিআইটিডিসি-র অধীনে। তখন কেনা এক-একটি বাসের দাম ছিল ২০ লক্ষ টাকার মতো। যার ১০ লক্ষের মতো টাকা মাসিক ২২ হাজার টাকা কিস্তিতে শোধ করার কথা ছিল বেসরকারি বাসমালিকদের। এমন নমনীয় শর্তের বিনিময়ে মালিকদের বাস ছাড়ার এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা হয়েছিল বিস্তর।
বছর দেড়েক ঠিকঠাক ঋণ শোধের পর থেকেই মালিকেরা ক্রমশ কিস্তির টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিতে শুরু করেন। লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে ঋণ। গত বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭ কোটি ৩০ লক্ষ ২১ হাজার ১৬৯ টাকা। কিন্তু মালিকেরা ঋণ শোধ না-করায় নিগমও নিরুপায়। গত অর্থবর্ষের শেষে সিএজি-ও বিষয়টির প্রবল সমালোচনা করে অবিলম্বে রাজ্যকে এ বিষয়ে কড়া ব্যবস্থা নিতে বলে।
এর পরেই নড়ে বসে সরকার। দশ মাস আগে থেকে ঋণ অদেয় রয়েছে, এমন বাস আটক শুরু হয়। ডিসেম্বরের মধ্যে ১৯টি বাস আটক করা হয়। ঠিক হয়, ১৯টি বাস পরীক্ষামূলক ভাবে চালাবে সিএসটিসি। সফল হলে বেসরকারি মালিকদের থেকে জেএনএনইউআরএম-এর সব বাস বাজেয়াপ্ত করে সরকার নিজেই চালাবে। এই সিদ্ধান্তের পরে চাপে পড়ে প্রায় ৭০ জন মালিক বাস ছেড়ে দিতে রাজি হয়ে যান। তাতেও বকেয়া টাকা আদায় করা নিশ্চিত হচ্ছিল না। এর পরেই সরকার ‘পোস্ট ডেটেড চেক’-এর বিনিময়ে বাসগুলি ফের মালিকদের হাতে ছাড়ার এই সিদ্ধান্ত নেয়। সরকারের শর্ত মেনে নেন মালিকেরা।
কিন্তু ‘পোস্ট ডেটেড চেক’ কেন?
এক পরিবহণকর্তার বক্তব্য, “পোস্ট ডেটেড চেক দিয়ে সাধারণত কেউই কথার খেলাপ করেন না। এই প্রক্রিয়ায় কিছুটা হলেও টাকা উদ্ধার হবে বলে মনে করা হচ্ছে।” ওই কর্তা জানান, পোস্ট ডেটেড চেক-এর সঙ্গে মালিকদের একটি নোটারি জমা দিতে বলা হয়েছে। তাতে বলা থাকবে, তাঁরা স্বেচ্ছায় চেক জমা দিচ্ছেন। পরে চেক বাউন্স করলে সংশ্লিষ্ট বাসমালিকদের বিরুদ্ধে ভারতীয় ফৌজদারি দণ্ডবিধির আওতায় মামলা করা যাবে। পরিবহণ দফতর সূত্রে খবর, আজ, সোমবার থেকে ওই প্রক্রিয়ায় আটক বাস ছেড়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে।
তবে সরকারের প্রস্তাবে সম্মত হলেও তা খানিকটা বাধ্য হয়েই বলেই দাবি বাসমালিকদের। বাসমালিকদের সংগঠন জয়েন্ট কাউন্সিল অব বাস সিন্ডিকেট্স-এর নেতা তপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “পরিবহণমন্ত্রী জেলে। আমাদের কথা কেউই শুনছেন না। ডিসেম্বর থেকে বাসগুলি পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। এর পরে চালানোই যাবে না। আমরা তাই রাজি হয়েছি। কিন্তু একই সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বিষয়টি নিয়ে সবিস্তার আলোচনা করার দাবি জানিয়েছি। মুখ্যমন্ত্রী আমাদের সমস্যাটা বুঝবেন বলে আশা।” বেঙ্গল বাস সিন্ডিকেটের নেতা দীপক সরকারের বক্তব্য, “তেলের দাম এখন কিছুটা কমেছে। মালিকদেরও টাকা দেওয়াই উচিত। ১২ হাজার টাকা করে দিয়ে তাঁরা যদি বাস চালাতে পারে, তা হলে ভালই। অন্তত সমস্যার সমাধান হবে।”