জয়ী: বিমলেন্দু সিংহ রায়, তপন দেবসিংহ ও প্রদীপ সরকার। ছবি: প্রণব দেবনাথ, চিরঞ্জীব দাস, দেবরাজ ঘোষ।
উপনির্বাচন অনেক সময়ই নিস্তরঙ্গ ভাবে কেটে যায়। বিশেষ শোরগোল পড়ে না। কিন্তু এ বার রাজ্য রাজনীতি রীতিমতো আলোড়িত। কারণ তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন ছিল রাজনৈতিক বার্তাবহ। বিজেপির বিরুদ্ধে রায়ে সেই বার্তা স্পষ্ট হয়েছে।
গত লোকসভা নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে এই লড়াই আসলে ছিল ‘আহত’ তৃণমূলের সঙ্গে ‘উজ্জীবিত’ বিজেপির। ফল দু’দলের কাছেই অপ্রত্যাশিত। রাজনীতির পণ্ডিতেরা অবশ্য ভাঙলেও মচকান না! তাই এই ফলাফল নিয়েও হয়তো সবাই নিজের মতো ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝাতে পারেন, এমনটাই হওয়ার ছিল।
কিন্তু ঘটনা হল, বিজেপি-কে তিনে শূন্য করে দেওয়ার ‘আশাবাদী’ হিসেব তৃণমূলের উপরতলাও কষেনি। অপর দিকে বিজেপি-ও ভাবতে পারেনি, করিমপুর ছাড়া খড়্গপুর এবং বিশেষ করে কালিয়াগঞ্জ থেকেও তাদের হেরে ফিরতে হবে। ঠিক যেমন লোকসভায় ১৮টি আসন হারাতে হবে, ভাবতে পারেনি তৃণমূল।
যে তিনটি আসনে উপনির্বাচন হল, তার মধ্যে একমাত্র করিমপুরই ছিল তৃণমূলের হাতে। তবে এ বার সেখানে জয়ের ব্যবধান ২০১৬-র বিধানসভা এবং ২০১৯-এর লোকসভা ভোটকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। কালিয়াগঞ্জে ব্যবধান খুব বেশি না হলেও এই প্রথম সেখানে জিতল তৃণমূল। তা-ও বিজেপি-কে হারিয়ে। আর খড়্গপুরে তৃণমূলের এই প্রথম জয় যাঁকে সবচেয়ে বড় ধাক্কা দিল, তিনি এই কেন্দ্রের প্রাক্তন বিধায়ক, বর্তমান সাংসদ ও বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ।
মাস ছয়েকের মধ্যে তৃণমূলের এই পুনরুত্থানের পিছনে একটি বা দু’টি কারণ খুঁজলে তাতে অন্ধের হস্তিদর্শন হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। তবে এটা ঠিক যে, মানুষ যখন ভোট দেন, তখন তাঁর বিবেচনায় প্রধানত একটি-দু’টি বিষয় বড় হয়ে ওঠে। এই ভোটে যেমন জাতীয় নাগরিক পঞ্জি বা এনআরসি। সেই সঙ্গে গত ছ’মাসে তৃণমূলকে ‘বদলে’ দেওয়ার জন্য মমতার চেষ্টাও ভোটদাতাদের নজরে এসেছে।
গোটা দেশে এনআরসি চালু করা ও সংসদে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ করিয়ে প্রতিটি দেশবাসীর ঘাড়ে নিজের ‘ভারতীয়ত্ব’ প্রমাণ করানোর দায় চাপানোর যে প্রচেষ্টা বিজেপি চালাচ্ছে, ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে জনগণ তাতে আতঙ্কিত। অসমের নাগরিক পঞ্জি থেকে ১২ লক্ষ হিন্দু-সহ ১৯ লক্ষ বাসিন্দার নাম বাদ পড়ার পরে সেই ভয় আরও বেড়েছে। এই রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ ক্ষেত্রে এক বড় ‘ভরসা’ হয়ে উঠলেন।
শেষ পর্যন্ত জল কোথায় গড়াবে, বলা কঠিন। তবে মমতা যে ভাবে এই রাজ্যে ‘যে কোনও মূল্যে’ এনআরসি রুখবেন বলে দাবি করেছেন, আতঙ্কিত মানুষদের পক্ষে এখন তা এক নির্ভরযোগ্য বিকল্প হয়েছে। অমিত শাহের ‘এনআরসি হবেই’ বলার বিরুদ্ধে মমতার দলের প্রতি সমর্থন প্রকাশ যেন এই লড়াইয়ের হাতিয়ার।
যে তিন কেন্দ্রে এই উপনির্বাচন হল, তার মধ্যে নদিয়ার করিমপুরে মুসলিম এবং উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জে রাজবংশী ভোট ফলাফল নির্ধারণে বড় ভূমিকা নিয়েছে। খড়্গপুরের ফলে ছাপ ফেলেছে রেল কলোনির অবাঙালি ভোট। এবং তিনটি কেন্দ্রেই ধাক্কা খেয়ে বিজেপি নেতারা খোলাখুলি মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন যে, এনআরসি-ভূত ঘাড় মটকেছে! বলা যেতে পারে, তৃণমূলের এই সাফল্যের পিছনে কিছুটা ‘অবদান’ তা-ই অমিত শাহেরও!
এ বার তাদের দল কী করবে, শাহ তাঁর ঘোষিত অবস্থান থেকে সরে আসতে পারবেন কিনা, সর্বোপরি মানুষ তাতে আস্থা রাখতে পারবে কিনা— এ সব ভবিষ্যতের প্রশ্ন। শাহ অবশ্য বৃহস্পতিবার ভোটের ফল প্রকাশের পরেও সদম্ভে বলেছেন, এনআরসি হবেই। তবে আপাতত এটা বেশ পরিষ্কার, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দের বাংলায় ভেদাভেদের সঙ্কীর্ণতা শেষ কথা বলে না। জনগণও তা বরদাস্ত করে না। কারণ বাংলা আশ্রয় দিতে জানে, তাড়াতে নয়।
এ তো গেল ফলাফলের একটি দিক, যা সবচেয়ে বেশি নজরে পড়ার। তৃণমূলের ‘ঘুরে’ দাঁড়ানোর পিছনে আরও যা কাজ করেছে, তার অন্যতম হল ‘সংশোধিত’ তৃণমূলকে তুলে ধরার চেষ্টা। লোকসভা নির্বাচনে ধাক্কা খাওয়ার পরে সরকার এবং সংগঠন পরিচালনায় কিছু বদল এনেছেন মমতা। প্রশাসনের অন্দরে দলের ‘প্রভাবশালী’ অংশের হস্তক্ষেপ নিয়ে বহু অভিযোগ দানা বেঁধেছিল। লোকসভার ফল পর্যালোচনার সময় সেই সব কথা সামনে আসে। মমতা প্রশাসনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করার চেষ্টা শুরু করেন। দলের পরিচালন প্রক্রিয়াতেও আদি বা পুরনো তৃণমূলদের সঙ্গে ‘নব্য-যুব’ অংশের বিবাদ বেআব্রু হয়ে পড়েছিল অনেক জেলায়। মমতা দৃশ্যত কড়া হাতে লাগাম ধরেছেন সেখানেও। সর্বত্র একশো ভাগ করতে না-পারলেও সব মিলিয়ে একটা অন্য রকম আবহ কিন্তু গত কয়েক মাসে তৈরি হয়েছে। মানুষের হারানো আস্থা ফেরানোর তাগিদ যার মূলে।
এই সে দিনও মমতা বলেছেন, ‘‘দলে কেউ নেতা নয়। দলের প্রতীকই হল আসল নেতা’’ দলীয় দ্বন্দ্বে দীর্ণ একাধিক জেলায় তিনি নিজে সংগঠন দেখবেন বলেও জানিয়েছেন। যার অর্থ, এ বার অনভিজ্ঞ বা অপটু হাতের ‘ছড়ি’ ঘোরানো তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে চান। পাশাপাশি, দল এবং সরকারে দুর্নীতি দমনে সক্রিয় হওয়ার বার্তাও মমতা দিয়েছেন।
অনেকের মতে, এ ভাবে নতুন ছকে সাজানোর পিছনে ভোট-কুশলী প্রশান্ত কিশোরের পরামর্শ কাজ করেছে। উপনির্বাচনের প্রচার পরিকল্পনার নেপথ্যেও টিম পিকে-র ভূমিকা ছিল। ভোটের ফলের পরে তৃণমূল শিবিরে রসিকতা চলছে, ‘থ্রি কে (তিন কেন্দ্রের আদ্যক্ষর) গোজ টু পিকে’! ২০২১-এ তৃণমূলের ভোট-পরিকল্পনা রূপায়ণও তো তাঁরই হাতে। প্রথম পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ।
তবে শরীরে গোপন ক্ষত থাকলে উপরের অঙ্গসজ্জা কাজে আসে না। মমতার চেয়ে ভাল তা কে বোঝেন! লোকসভা ভোটে ঘা-খাওয়া তৃণমূল নেত্রী তা-ই ক্রমশ দলকে ‘শিকড়ে’ ফেরানোর পথে নিয়ে যাচ্ছেন। এ বারের প্রার্থী বাছাই পর্বে তিনি আস্থা রেখেছিলেন স্থানীয় স্তর থেকে আসা তালিকার উপর। পাশাপাশি কাজ করেছে পিকে-র অনুসন্ধানী রিপোর্টও।
আরও একটি কাজ তিনি করেছিলেন। কোন কেন্দ্রে কার কী দায়িত্ব, কে যাবেন বা যাবেন না— কঠোর ভাবে বেঁধে দিয়েছিলেন সব। লোক দেখল, লোকসভা নির্বাচনের আগেও যাঁদের অবাঞ্ছিত দাপাদাপিতে অতিষ্ঠ বোধ হত, সেই দাপুটেরা অনেকটা ‘সংযত’। পর্যবেক্ষকেরা অনেকে বলেছেন, গত লোকসভায় মানুষ তৃণমূলকে ‘সংযত’ হওয়ার শিক্ষাই দিতে চেয়েছিল। এই তিন উপনির্বাচনে তার কিছুটা প্রতিফলন ঘটেছে, সন্দেহ নেই। ২১-এর পথে যা মমতাকে বাড়তি অক্সিজেন জোগাবে।