গ্রাফিক—শৌভিক দেবনাথ।
বাংলায় নীলবাড়ি দখলের লক্ষ্যে তারা অন্তত ৫২ শতাংশ ভোট পাবে বলে মনে করছে শাসক তৃণমূল। তবে ভোটের শতাংশ বাড়লেও ২০১৬ সালের তুলনায় আসন কিছু কমবে বলেই মনে করছে তারা। সম্প্রতি তৃণমূলের শীর্ষনেতৃত্ব রাজ্যের সপ্তদশ বিধানসভা নির্বাচনের আগে আসনভিত্তিক হিসাব কষেছে। দলীয় সূত্রের বক্তব্য, সেই হিসেবে স্বস্তি পাওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। কারণ, সেই হিসাবে বলছে, অন্তত ৫২ শতাংশ ভোট নিয়ে তৃতীয়বারের জন্য নবান্নে প্রত্যাবর্তন ঘটবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
তৃণমূলের প্রাথমিক অভ্যন্তরীণ হিসাব অনুযায়ী, ১৯০ থেকে ২১০টি আসন পেতে পারে তৃণমূল। ২০১৬ সালে ৪৪.৯ শতাংশ ভোট পেয়ে ২১১টি আসন জিতে ক্ষমতায় এসেছিল তৃণমূল। কিন্তু তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ হিসাবে এ বার ভোট শতাংশ বাড়লেও সেই তুলনায় কিন্তু আসন বৃদ্ধির ইঙ্গিত নেই। সেই বিষয়টি তৃণমূল নেতৃত্বকে ভাবাচ্ছে কি না বা ভাবালেও সেটি মেরামতের জন্য তাঁরা কী করার কথা ভাবছেন, তা নিয়ে এখনই কেউ মন্তব্য করতে চাইছেন না।
প্রসঙ্গত, বিজেপি তাদের অভ্যন্তরীণ সমীক্ষায় মনে করছে, তারা ১৫০ থেকে ১৬০টি আসন পেতে পারে। শনিবারই আনন্দবাজার ডিজিটালে সেই খবর প্রকাশিত হয়েছিল।
আরও পড়ুন : বঙ্গে কত আসন পেতে পারে পদ্ম? অভ্যন্তরীণ সমীক্ষা করেছে বিজেপি
ঘটনাচক্রে, ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের নিরিখে তৃণমূল রাজ্যের ১৬৪টি আসনে এগিয়ে রয়েছে। বিজেপি এগিয়ে রয়েছে ১২১টি আসনে। বাংলায় ক্ষমতা দখলের জন্য প্রয়োজনীয় ‘ম্যাজিক ফিগার’ হল ১৪৮টি আসন। অর্থাৎ, তৃণমূল ওই ম্যাজিক ফিগারের চেয়ে ১৬টি আসনে এগিয়ে। তৃণমূলে অভ্যন্তরীণ হিসাব বলছে, বিধানসভা ভোটে তারা আরও ৪৬টি বেশি আসন জিতবে। কী করে তারা ১৬৪টি থেকে ২১০ আসনে পৌঁছবে, তার ব্যাখ্যাও অভ্যন্তরীণ সমীক্ষায় দেওয়া হচ্ছে।
তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ হিসেব মূলত তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে করা হয়েছে বলেই দলীয় সূত্রের দাবি। এক, ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটে প্রধানমন্ত্রিত্বের দৌড়ে ছিলেন না মমতা। তিনি কোনও লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থীও হননি। কিন্তু বিধানসভা ভোটে মমতাই হবেন তৃণমূলের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী। তিনি ভোটে প্রার্থীও হবেন। মুখ্যমন্ত্রিত্বের প্রশ্নে বাংলার জনতা মমতাকেই বেছে নেবে। দ্বিতীয়ত, লোকসভা ভোটে নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রী পদে ফেরানোর জন্য ভোট দিয়েছিলেন বাংলার মানুষের একাংশ। কিন্তু বিধানসভা ভোটে বিজেপি-র হয়ে ভোট চাইবেন দিলীপ ঘোষ। মোদীর সঙ্গে দিলীপের ভাবর্মূতির বিস্তর ফারাক। মোদীর মুখকে সামনে রেখে বিজেপি যতটা ভোট বাড়াতে পেরেছিল, দিলীপকে সামনে রেখে রাজ্য বিজেপি তা পারবে না। বরং দিলীপের চেয়ে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা অনেক বেশি ‘গ্রহণযোগ্য’ বাংলার মানুষের কাছে।
আরও পড়ুন : আব্বাসের নেতৃত্বেই বাংলায় লড়ব, ফুরফুরা শরিফ থেকে ঘোষণা ওয়াইসির
তৃতীয়ত, লোকসভা ভোটের পর পশ্চিমবঙ্গের জেলাভিত্তিক পরিস্থিতি এখন তৃণমূলের অনুকূলে। বিমল গুরুংয়ের পাহাড়ে তৃণমূলের হয়ে প্রত্যাবর্তন উত্তরে বিজেপি-কে খানিকটা পিছনে ঠেলে দেবে বলেই অভিমত তৃণমূল নেতৃত্বের। গুরুংয়ের কারণেই লোকসভা ভোটে দার্জিলিং ও আলিপুরদুয়ার জেলার পাঁচটি করে আসনে বড় ব্যবধানে এগিয়ে ছিলেন বিজেপি প্রার্থীরা। তৃণমূলের হিসাবে গুরুং শিবির বদল করায় ওই আসনগুলির ফলাফল ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যাবে। জঙ্গলমহলেও লোকসভায় গেরুয়া শিবির যে দাপট দেখিয়েছিল, তা-ও নিরঙ্কুশ থাকবে না বলেই তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ হিসাব।
তৃণমূলের দাবি দিলীপের চেয়ে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা অনেক বেশি ‘গ্রহণযোগ্য’ বাংলার মানুষের কাছে।
তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ হিসাবে আরও একটি পরিসংখ্যান দেওয়া হচ্ছে। দলীয় নেতৃত্ব বলছেন, গত ৭০ বছরের ভোট রাজনীতিতে যারা কলকাতার সিংহভাগ আসন জিতেছে, তারাই পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা দখল করেছে। শুধুমাত্র ২০০১ সালের বিধানসভা ভোট ছাড়া। রাজ্যের একাধিক জেলায় বিজেপি-র সংগঠন জোরালো ভাবে দানা বাঁধলেও খাস কলকাতায় এখনও পদ্ম শিবির দুর্বল। তাই তৃণমূলের ওই হিসাবে কলকাতা-সহ দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় তৃণমূলের দাপট অব্যাহত থাকবে বলেই ধরে নেওয়া হয়েছে।
নদিয়া, বীরভুম ও মুর্শিদাবাদের মতো জেলাগুলিতেও বিজেপি-র থেকে দল ভাল ফল করবে বলে ধরে নিয়েই আসনের হিসাব কষেছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। তাঁদের দাবি, শুভেন্দু অধিকারীর দলবদলের পর পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সংগঠন যতটা ধাক্কা খাবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল, তার অনেকটা সামাল দেওয়া গিয়েছে। ফলে সেখানেও খুব খারাপ ফল হবে বলে মনে করছেন না তৃণমূল নেতৃত্ব।
তৃণমূল শিবির সূত্রে আরও বলা হচ্ছে, লোকসভা ভোটের পর যে পাঁচটি রাজ্যের নির্বাচন হয়েছে, সবক’টিতেই ধারাবাহিক ভাবে ভোট কমেছে বিজেপি-র। পরিসংখ্যান বলছে, মহারাষ্ট্রে তাদের ভোট কমেছে ৮ শতাংশ, হরিয়ানায় ২১ শতাংশ, ঝাড়খণ্ডে ২২ শতাংশ, দিল্লিতে ১৬ শতাংশ এবং বিহারে ১২ শতাংশ। তবে বাংলার ভোট নিয়ে বেশ কয়েকটি সমীক্ষার রিপোর্ট জেনেছেন তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব। সেগুলিতে অবশ্য বলা হচ্ছে, বাংলার নির্বাচনে বিজেপি-র ভোট কমার সম্ভাবনা ক্ষীণ। গত লোকসভা ভোটে রাজ্যে মোট ৪০.২ শতাংশ ভোট পেয়েছিল বিজেপি। এবারও তাদের তেমনই ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জেনেছে তৃণমূল।
আরও পড়ুন : শুভেন্দুকে নিয়ে নিজভূমে দিলীপ, রবিতে যুগলবন্দি গোপীবল্লভপুরে
তবে গত লোকসভা ভোটে আলাদা লড়ে বাম এবং কংগ্রেস সম্মিলিতভাবে ১৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। বিধানসভায় জোটবদ্ধ লড়াই করলেও সেই ভোট আরও কমবে বলেই তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ সমীক্ষায় উঠে এসেছে। তাই বিধানসভা ভোটে বিজেপি-কেই মূল প্রতিপক্ষ ধরছে তৃণমূল। তাদের অভ্যন্তরীণ হিসাব বলছে, বিজেপি-র চেয়ে তারা অন্তত ১২ শতাংশ ভোট বেশি পাবে।
দলের অভ্যন্তরীণ এই হিসাব নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি তৃণমূলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন। প্রতিপক্ষকে কটাক্ষ করে তৃণমূলের রাজ্যসভার দলনেতা বলছেন,‘‘রাজ্য বিজেপি এখন তিনভাগে বিভক্ত। ওল্ড বিজেপি, নিউ বিজেপি এবং টুরিস্ট গ্যাং বিজেপি। পুরোনো-নতুনদের মধ্যে বিবাদের মধ্যেই একদল বহিরাগত বিজেপি নেতা বাংলায় ঘুরতে আসছেন। তাঁদের বলতে চাই, বাংলায় এসব করে কোনও লাভ নেই। দিদি আছেন। দিদিই থাকবেন।’’