পুরুলিয়ায় সৃষ্টিধর মাহাতো। ছবি: সুজিত মাহাতো
তৃণমূলের সৃষ্টিলগ্ন থেকে দলের সঙ্গে পুরুলিয়ায় সৃষ্টিধর।
কিন্তু এখন?
আর তৃণমূল করব না! গলায় হতাশা সৃষ্টিধর মাহাতোর। আর এই আক্ষেপ পুরুলিয়ায় লোকসভা ভোটে তৃণমূলের বিপর্যয়ের মর্মকথা।
পর্যবেক্ষকদের মতে, দলে কোণঠাসা পুরনোদের ক্ষোভের প্রতিফলন ভোটবাক্সে ঘটেছে। বিষয়টি দলীয় নেতৃত্বও যে অস্বীকার করতে পারছেন না, তা স্পষ্ট। কারণ, এই জেলায় একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ে পর্যবেক্ষক ছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ভোটের ফল দেখে তাঁকে সরিয়েছে দল। এমনকি, পুরনোদের সসম্মানে ফিরিয়ে আনার কথা প্রতিটি দলীয় বৈঠকে নিয়ম করে বলছেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তৃণমূলের পুরনোদের ক্ষোভের উৎস খুঁজতে গিয়ে এই জেলায় সবার আগে আসে সৃষ্টিধরের কথা। এক সময়ে বলরামপুর মাওবাদীদের শক্ত ঘাঁটি ছিল। সেখানে ব্লক সভাপতি ছিলেন সৃষ্টিধর। পরে জেলা পরিষদের সভাধিপতি হন তিনি। অযোধ্যা পাহাড় লাগোয়া নির্মীয়মাণ পর্যটন আবাসের খাটিয়ায় বসে তিনি বললেন, ‘‘জেলায় ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের সর্বোচ্চ দায়িত্বে ছিলাম। হেরেছি। সব ছেড়েছি। লোকসভা ভোটে রাজ্যের নির্বাচনে দলের দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা কি আমার মতো একই কাজ করবেন?’’
এখনই বিজেপির সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের প্রসঙ্গ অবশ্য উহ্য রাখছেন ৬৩ বছর বয়সি সৃষ্টিধর। বলছেন, ‘‘সময়-সুযোগ আর সম্ভাবনা মিলিয়ে রাজনীতি।’’ তবে এ-ও বলছেন, ‘‘নরেন্দ্র মোদীর বিভিন্ন পদক্ষেপ দেশের মানুষ দু’হাত ভরে সমর্থন করেছেন। অথচ অনেকে মোদীর বিরোধিতা করেছেন। মানুষ তা ভাল ভাবে নেননি।’’ জেলার অনেক নেতাই কিন্তু ‘মুখ’ বদলানো শুরু করেছেন। তৃণমূলের জেলা সভাপতি শান্তিরাম মাহাতোর অবশ্য দাবি, এই বদল ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।
পঞ্চায়েত ভোটেই তৃণমূলের প্রতি অনাস্থার জানান দিয়েছিল পুরুলিয়া। কার্যত ‘গায়ের জোরে’ আস্থা আদায়ের অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে। সে ক্ষেত্রে গুরুত্ব পায়নি জেলা নেতৃত্বের মত। গরু চরানোর মাঝে পিচ রাস্তায় জিরিয়ে নিচ্ছিলেন আড়শার শিকরাবাদের প্রৌঢ় গরুর বাগাল (রাখাল) দেওয়া সুভাষ রাজোয়াড়। স্থানীয় ভাষায় বললেন, ‘‘পঞ্চায়েত ভোটে লোকে বিজেপিকে দিয়েছিল। উয়ারা মেজরিটি পেয়েছিল। তা-ও গঠন (বোর্ড) হয়নি। এ বার তো মেজরিটি মোদী পেয়েছে। এ বার কী করবে উয়ারা (তৃণমূল)!’’ তা মেনে তৃণমূলের এক নেতার বক্তব্য, ‘‘পঞ্চায়েত ভোটে আমাদের ভূমিকা ঠিক হয়নি। এক বছর হতে চললেও জেলা পরিষদের এবং কয়েকটি পঞ্চায়েত সমিতিতেও স্থায়ী সমিতি নেই। এখনও মানুষ পরিষেবা
পাচ্ছেন না।’’
ক্ষোভ রয়েছে স্থানীয় নেতাদের নিয়েও। যেমন কাশীপুরে বিভিন্ন পদে বেলথরিয়া পরিবারের অবস্থান ‘অস্ত্র’ স্থানীয়দের। কাশীপুরের বিধায়ক স্বপন বেলথরিয়া। ছেলে সৌমেন জেলা পরিষদের সদস্য। মেয়ে সুপ্রিয়া কাশীপুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি। এক নেতার কথায়, ‘‘একটা মানুষের কাপড়ের প্রয়োজন হলেও তা-ও স্থির করেন বেলথরিয়ারা। তবে অঞ্চল সভাপতির কাজ কী!’’ সৌমেনের বক্তব্য, ‘‘সংগঠনে যা প্রয়োজন হয়, তা-ই করেন বিধায়ক।’’ পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ নিয়ে কোনও মন্তব্য করলেন না তিনি। বেলথরিয়া পরিবারের এক ঘনিষ্ঠের কথায়, ‘‘পরিবারের মধ্যে থাকলে সহজে সংগঠন বাঁধা যায়। বাইরের হলে অনেক কথা শোনেন না।’’ ঘটনাচক্রে, পুরুলিয়ার দায়িত্বে ছিলেন যুব তৃণমূল সভাপতি, মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো অভিষেক।
অভিষেক দায়িত্বে থাকলে পরবর্তী নির্বাচনে সুবিধা হত বলে দাবি জেলা বিজেপি সভাপতি বিদ্যাসাগর চক্রবর্তীর। তাঁর কথায়, ‘‘পুরুলিয়ার মানুষ জানেন, পঞ্চায়েত নির্বাচন বা পরবর্তীতে অভিষেক কী ভাবে জেলার সংস্কৃতিকে বদলে দিয়েছিলেন।’’
বছর খানেক আগে বলরামপুরের ডাভা এবং সুপুরডিতে ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয় দুলাল কুমার এবং ত্রিলোচন মাহাতোর। বছর ঘুরলেও রাত পাহারা দেন স্থানীয়েরা। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘যারা মারল, তারা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাই ভয় হয়।’’
যদিও তুড়ি মেরে (হাতের মুদ্রায় দেখালেন) জেলা পরিষদ দখলের (ইচ্ছা করলেই পারেন) দাবি করছেন আত্মবিশ্বাসী বিজেপি সাংসদ জ্যোতির্ময় সিংহ মাহাতো। দলবদল করিয়ে জেলা পরিষদ বা পুরসভা দখলে আনলে পুরুলিয়াবাসী কতটা ভালভাবে নেবেন, তা নিয়ে অবশ্য দোলাচলে জেলার পদ্ম নেতৃত্ব। জেলা সভাপতির কথায়, ‘‘আড়াই বছরের আগে সভাধিপতির বিরুদ্ধে অনাস্থা আনা যাবে না। তা হলে খামোকা কেন ঘাড়ে করে বইব!’’ আপাত তাই থমকে বিজেপির ‘শক্তিবৃদ্ধি’র প্রকাশ।
আর এটাও ঘটনা যে, দু’লক্ষের বেশি ব্যবধানে লোকসভার আসনটি পকেটে পুরলেও পুরুলিয়ার ইতিউতি ঘুরে বোঝা গেল, বিজেপির সভা-সমিতিতে লোকের টান পড়ছে। সরাসরি তা স্বীকার না করেও এক নেতা বলছেন, ‘‘ভোটের সময়ে মানুষের মধ্যে অন্য রকম আবেগ কাজ করে। সেই আবেগ সব সময়ে
থাকে না।’’