প্রবীর ঘোষাল।
উত্তরপাড়ার তৃণমূল বিধায়ককে শোকজ করল তৃণমূল। সোমবার পুড়শুড়ায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনসভায় তাঁর অনুপস্থিতি নজর পড়েছিল। কোনও সাফাই না দিয়েই তিনি জানিয়েছিলেন, মঙ্গলবার সাংবাদিক বৈঠক করে নিজের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করবেন। এদিন কোন্নগর সুইমিং পুলে উত্তরপাড়ার তৃণমূল বিধায়ক জানিয়ে দিলেন, হুগলি জেলা তৃণমূলের মুখপাত্র ও কোর কমিটির সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দিচ্ছেন। সঙ্গে দলের কর্মপদ্ধতিরও সমালোচনা করেন। এর কিছু পরেই প্রবীরকে শোকজ করল তৃণমূল, সঙ্গে দল প্রসঙ্গে নানা নেতিবাচক মন্তব্যের প্রেক্ষিতে সতর্কও করা হল তাঁকে।
গত কয়েক মাস ধরেই দলের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছিল প্রবীরের। মাঝে মধ্যে দলীয় অবস্থানের বিরুদ্ধে মুখ খুলে দলের বিড়ম্বনা বাড়াচ্ছিলেন তিনি। এ দিন অবশ্য কোনও রাখঢাক না করেই একের পর এক দলীয় সিদ্ধান্তকে কাঠগড়ায় তোলেন প্রবীর। তিনি বলেন, ‘‘ভাল মানুষরা দলে থেকে কাজ না করতে পেরে একে একে দল ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। আমিও একাধিকবার বলেও কোনও সুরাহা হয়নি। তাই আমি আজ দলের দেওয়া পদ ছাড়ার কথা ঘোষণা করছি।’’ প্রবীর আরও বলেছেন, ‘‘এক সময় বিধায়ক পদ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু পরে ভেবে দেখেছি, বিধায়ক না থাকলে স্থানীয় মানুষ নানা অসুবিধায় পড়বেন। সে কথা চিন্তা করেই বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দিচ্ছি না।’’
দলীয় পদ থেকে তিনি ইস্তফা দিলেও, সাধারণ সদস্য হিসেবেই কাজ করবেন বলে জানিয়েছেন তিনি। অভিযোগের সুরে প্রবীর বলেন, ‘‘দলের মধ্যে থেকেই আমাকে হারানোর চেষ্টা হচ্ছে। লোকসভা ভোটে আমরা অন্তর্কলহের কারণে হুগলি আসন হেরে যাই। দলের অন্দরে বলেও কোনও লাভ হয়নি।’’ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রবীরবাবুর সর্ম্পক দীর্ঘদিনের। সে কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘‘যেদিন লক্ষ্মীরতন শুক্ল মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দেন, সেদিনই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আমার ফোনে কথা হয়। তাঁকেও আমি সমস্যার কথা জানাই। তিনি বলেন, অন্য আসন থেকে দাঁড়ানোর কথা। আমি তাঁকে জানাই, আমি উত্তরপাড়ার ভূমিপুত্র। দাঁড়ালে এখান থেকেই দাঁড়াব, নাহলে কোনও জায়গা থেকে নয়।’’
তাঁর এমন সব সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে সংবাদমাধ্যমের একঝাঁক প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। ভোটের আগে দলবদল করতেই কি এমন সিদ্ধান্ত? প্রশ্নের মুখে পড়ে উত্তরপাড়ার বিধায়ক বলেন, ‘‘লোকসভা ভোটে হুগলি জেলায় আমাদের ফল খারাপ হয়েছিল। তারপর সংগঠনে পরিবর্তন আনা হয়। কিন্তু তা কতটা ফলপ্রসূ হয়েছে,তা নিয়ে সংশয় রয়ে গিয়েছে। সংগঠন এবং সরকারের কাজকর্ম দু’দিকেই বেশ কিছু ত্রুটি রয়ে গিয়েছে। এটা বলতে আমার দ্বিধা নেই।’’ এদিন ভোট কৌশলী প্রশান্ত কিশোরের ‘স্ট্র্যাটেজি’ নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেছন প্রবীরবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘লোকসভা ভোটে আমরা খারাপ ফল করেছিলাম। কিন্তু পিকে দায়িত্ব নেওয়ার পর দলীয় কোন্দল আরও বেড়ে গিয়েছে। এর ফল আগামী দিনে ভালো হবে না।’’ তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়া শুভেন্দু অধিকারী ও মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দেওয়া রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষ নিয়েও দলের অস্বস্তি বাড়িয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘‘রাজীবের মতো ভালো ছেলেও থাকতে পারল না। কত ভালো কাজ করেছিল মন্ত্রী হিসেবে। কিন্তু ও থাকতে পারল না।’’ শুভেন্দু প্রসঙ্গে তাঁর ছোট্ট মন্তব্য, ‘‘সংগঠক হিসেবে অত্যন্ত দক্ষ।’’ দলবিরোধী মন্তব্যের জেরে শেষ পর্যন্ত বহিষ্কৃত হয়েছেন, বালির বিধায়ক বৈশালী ডালমিয়া। সেই প্রসঙ্গেও দলীয় সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘‘আমি ওঁর সব কথাই শুনেছি। দলের ভালোর জন্যই বলেছেন। আমরা কখনও মনে হয়নি, বহিষ্কার করার মতো কোনও কথা বলেছেন।’’
প্রসঙ্গত, উত্তরপাড়ার তৃণমূল বিধায়কের এমন বিদ্রোহী সাংবাদিক সম্মেলনের পরেই তাঁর বিরুদ্ধে খড়হস্ত হন শ্রীরামপুরের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘যাঁরা কাজ করতে চান, তাঁদের কোনও পদ লাগে না। ২০১৬ সালে মমতাদি টিকিট দিয়েছিলেন বলেই বিধায়ক হয়েছিলেন। তাই এত বড় বড় কথা বলছেন, আসলে উনি হচ্ছেন দুমুখো সাপ।’’ প্রবীরের সাংবাদিক সম্মেলন শেষ হওয়া মাত্রই তাঁর অফিসের সামনে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন তৃণমূল কর্মীরা। বিক্ষোভ দেখিয়ে তাঁরা স্লোগান তোলেন, ‘গদ্দার হঠাও!’ প্রসঙ্গত, হুগলী জেলা তৃণমূলে প্রবীরবাবুর সঙ্গে হুগলী জেলা তৃণমূলের সভাপতি দিলীপ যাদবের দ্বন্দ্ব সর্বজনবিদিত। সূত্রের খবর, এদিন বিধায়ক কার্যালয়ের সামনে দিলীপ আনুগামীরাই ‘গদ্দার হঠাও’ স্লোগান দিয়ে প্রবীরবাবুর অপসারণের দাবি তুলেছেন। প্রসঙ্গত, সাংবাদিক হিসেবে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে প্রবীরবাবুর সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। সূত্রের খবর, সেই সম্পর্কের জেরেই এদিন উত্তরপাড়ার বিধায়ককে শোকজ ও সতর্ক করেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। দলীয় শোকজ ও বিক্ষোভ প্রসঙ্গে প্রবীর বলেছেন, ‘‘আগে দেখি কী বিষয়ে ওরা জানতে চেয়েছে। তারপর উত্তর দেব। আর বিক্ষোভ প্রসঙ্গে কি আর বলব। উত্তরপাড়ার মানুষ আমার সঙ্গে রয়েছে। আর যাঁরা আমাকে গদ্দার বলছেন, দলই তো আমার সঙ্গে গদ্দারি করেছে।’’