বিধানসভা ভোটে বিপুল জয়ের মধ্যেও যে সমস্ত পুর এলাকায় শাসক দলের ফল ভাল হয়নি, সেই সমস্ত পুরসভার এলাকায় বদলের প্রক্রিয়া শুরু হল তৃণমূলে। শাসক দল পরিচালিত ১১১ পুরসভার চেয়ারম্যানদের নিয়ে শনিবার তপসিয়া তৃণমূল ভবনে দলের রাজ্য নেতৃত্ব বৈঠকে বসেছিলেন। খারাপ ফলের জন্যে বেশ কয়েকটি পুরসভার চেয়ারম্যানদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ইঙ্গিত দলীয় নেতৃত্ব এ দিনের বৈঠকে দিয়েছেন বলে সূত্রের খবর।
তৃণমূল ২১১ আসনে জয়ী হলেও, শাসক দল পরিচালিত ৬১টি পুর এলাকায় দলীয় প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছেন। জয়ের তুমুল হাওয়া থাকা সত্ত্বেও ওই সব পুর এলাকায় খারাপ ফল নিয়ে ইতিমধ্যেই দলে ময়না তদন্ত শুরু হয়েছিল। কিন্তু এ দিনের বৈঠকে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সুব্রত বক্সী এবং সহ-সভাপতি মুকুল রায়ের উপস্থিতিতে এলাকা ধরে ধরে বিভিন্ন পুরসভার চেয়ারম্যানদের রীতিমতো জিজ্ঞাসাবাদ করেন পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম এবং কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়।
দলীয় নেতাদের একাংশের মতে, আগামী দু’বছরের মধ্যে পঞ্চায়েত ভোট। তার পরেই লোকসভার ভোট। তার আগে দলের সাংগঠনিক এবং প্রশাসনিক স্তরে ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করতে তৃণমূল নেতৃত্ব সক্রিয় হয়েছেন। নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে গত ১৮ জুন দলের কর্মশালায় তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট জানিয়েছেন, দলীয় নেতা ও কর্মীদের ‘পারফরম্যান্সের’ বিচার হবে। সেই প্রেক্ষিতে এ বারের ভোটে দলের পুরকর্তা থেকে শুরু করে জেলা সভাপতিদের কাজকর্মের মূল্যায়নের ভিত্তিতে রদবদলের ইঙ্গিতও সে দিন মমতা দিয়েছিলেন। এ দিনের বৈঠকে ‘ব্যর্থ’ পুরকর্তাদের নেত্রীর নির্দেশের কথা বুঝিয়ে দিয়েছেন মুকুলরা। তৃণমূল সূত্রে খবর, বেশ কয়েক জন জেলা সভাপতিকেও ব্যর্থতার অভিযোগে সরানোর তোড়জোড় শুরু হয়েছে।
এ দিন বৈঠকের পরে কয়েক জন চেয়ারম্যান জানান, কয়েকটি পুর এলাকায় দলীয় প্রার্থী হারা বা দলের ভোটের হার কমা নিয়ে রাজ্য নেতৃত্ব ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। রাজ্য নেতারা বৈঠকে প্রশ্ন তোলেন, অধিকাংশ এলাকায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের উন্নয়নকে সমর্থন জানিয়ে মানুষ ভোট দিলেও, কয়েকটি পুরসভায় কেন তারা তৃণমূলকে ভোট দেয়নি। নেতৃত্বের অভিমত, ওই সব পুর এলাকায় উন্নয়নের কাজে ত্রুটি, জনসংযোগের অভাব ছিল বলেই দলের ফল খারাপ হয়েছে। মালদহের ইংলিশবাজার, হুগলির বৈদ্যবাটি, শ্রীরামপুর, উত্তর ২৪ পরগনার কামারহাটির চেয়ারম্যানদের হারের কারণ নিয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা
হয়েছে বলে দলীয় সূত্রে খবর। ইংলিশবাজার পুরসভার চেয়ারম্যান কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী তাঁর হারের কারণ নিয়ে এ দিন লিখিত রিপোর্ট দিয়েছেন। সেখানে তিনি হারের কারণ হিসেবে, ‘কংগ্রেস-বাম-বিজেপি আঁতাঁত’ হয়েছিল বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তৃণমূল সূত্রের খবর, দলীয় নেতৃত্ব তাঁর ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নন।
বৈঠকে রাজ্য নেতারা জানিয়েছেন, এ বারের ভোটে যে ‘ক্ষত’ তৈরি হয়েছে তা দ্রুত সারিয়ে ফেলতে হবে। পুরকর্তাদের কয়েকটি ‘নির্দেশিকা’ও দিয়েছেন তাঁরা। ভোটে ফল খারাপ হওয়ার মুলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অন্তর্ঘাত ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের অভিযোগ উঠেছে। কামারহাটিতে মদন মিত্রের হারের কারণে যেমন দলের একাংশ আঙুল তুলেছেন সেখানকার পুরসভার চেয়ারম্যান গোপাল সাহার দিকে। আবার বর্ধমানের কাটোয়ায় দলীয় প্রার্থী রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় সামান্য ভোটে জিতলেও সেখানকার পুরসভার চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতের অভিযোগ উঠেছে। চাঁপদানিতে দলীয় প্রার্থীর হার নিয়ে সমালোচনা হয়েছে বৈদ্যবাটি, শ্রীরামপুর পুরসভার চেয়ারম্যানদের। তাঁদের কী সমস্যা হয়েছিল তা জানতে চান ববি, শোভনরা। সেই সঙ্গে রাজ্য নেতৃত্বের নির্দেশ, এলাকায় গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব হলে তা অবিলম্বে রাজ্য নেতৃত্বকে জানাতে হবে। সমস্যা মেটাতে স্থানীয় নেতৃত্ব আগ বাড়িয়ে কোনও ব্যবস্থা নেবেন না।
পাশাপাশি উন্নয়নের কাজে কোনও শিথিলতা বরদাস্ত করা হবে না বলে তাঁরা পুরকর্তাদের জানিয়ে দিয়েছেন। দলের এক শীর্ষ নেতা জানিয়েছেন, বিধানসভার ভোটে উন্নয়নের ফলে মানুষ উজাড় করে ভোট দিয়েছেন। পুর চেয়ারম্যানদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, তাঁদের এলাকায় বিপিএল শ্রেণিভুক্ত মানুষের সঠিক তালিকা তৈরি থেকে শুরু করে পানীয় জলের সমস্যা মেটানোর কাজ দ্রুত করতে হবে। সতর্ক করা হয়েছে, কোথাও জলের জন্য গরিব মানুষের উপর কর বসানো চলবে না। গৃহহীনদের জন্য বাসস্থান প্রকল্পের কাজে আরও গুরুত্ব দিতে হবে পুরকর্তাদের।