স্যান্টিয়াগো মার্টিন। — ফাইল চিত্র।
দেশে লটারি ব্যবসার ‘মুকুটহীন সম্রাট’ স্যান্টিয়াগো মার্টিনের সংস্থা ফিউচার গেমিং ও হোটেল সার্ভিসেসের কাছ থেকে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে ৫৪২ কোটি টাকা চাঁদা পেয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। মার্টিনের সংস্থা বিজেপিকে চাঁদা দিয়েছে ১০০ কোটি টাকা। পশ্চিমবঙ্গ-সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে লটারির ব্যবসায় যুক্ত ফিউচার গেমিংই নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলিকে সব থেকে বেশি (১৩৬৮ কোটি টাকা) চাঁদা দিয়েছিল। এখন হিসাব বেরোনোর পরে দেখা যাচ্ছে, তাদের কাছ থেকে সব চেয়ে বেশি টাকা চাঁদা মারফত পেয়েছে তৃণমূলই। এম কে স্ট্যালিনের দল ডিএমকে-ও ওই লটারি সংস্থার কাছ থেকে পেয়েছে ৫০৩ কোটি টাকা।
রাজনৈতিক দলগুলিকে চাঁদা বিলির হিসেবে দ্বিতীয় স্থানে থাকা সংস্থা মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার। কেন্দ্রীয় সরকারের একাধিক বড় মাপের প্রকল্প তৈরির কাজে যুক্ত মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং মোট ৯৮০ কোটি টাকা চাঁদা দিয়েছিল। তার মধ্যে ৫৮৪ কোটি টাকা পেয়েছে বিজেপি। মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং ও তার শাখা সংস্থা পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ বিদ্যুৎ পরিবহণ বিজেপিকে মোট ৬৬৪ কোটি টাকা চাঁদা দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, যে ১৮টি সংস্থা নির্বাচনী বন্ড মারফত সব থেকে বেশি চাঁদা দিয়েছে, দেখা যাচ্ছে, বিজেপির তহবিলে টাকা গিয়েছে তাদের প্রত্যেকের তরফ থেকে।
গোপনে রাজনৈতিক দলগুলিকে চাঁদা দেওয়ার জন্য তৈরি নির্বাচনী বন্ড সংক্রান্ত প্রাথমিক তথ্য প্রকাশ্যে আসার পরেই ফিউচার গেমিংয়ের নাম উঠে আসে। দেখা যায়, স্যান্টিয়াগো মার্টিনের এই সংস্থা মোট ১৩৬৮ কোটি টাকা চাঁদা দিয়েছে। তার পরে তামিলনাড়ুর শাসক দল ডিএমকে নিজে থেকেই জানিয়েছিল যে, তারা ওই সংস্থার থেকে ৫০৩ কোটি টাকা চাঁদা পেয়েছে। বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে স্টেট ব্যাঙ্ক নির্বাচনী বন্ড চিহ্নিত করার সংখ্যা-সহ সমস্ত তথ্য প্রকাশ্যে এনেছে। ফলে কোন রাজনৈতিক দল কবে কোন কর্পোরেট সংস্থার থেকে চাঁদা পেয়েছে, তা স্পষ্ট ভাবে বোঝা গিয়েছে। তাতেই দেখা যাচ্ছে, মার্টিনের সংস্থা তৃণমূলকেই সব থেকে বেশি চাঁদা দিয়েছে। যার অঙ্ক ৫৪২ কোটি। অর্থাৎ, মার্টিনের মোট চাঁদার শতকরা ৪০ ভাগই তৃণমূল পেয়েছে। ডিএমকে-র ৫০৩ কোটি টাকা ছাড়াও অন্ধ্রপ্রদেশের শাসক দল ওয়াইএসআর কংগ্রেস পেয়েছে ১৫৪ কোটি টাকা। আর বিজেপি ১০০ কোটি।
মোদী সরকারের চালু করা নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে বিজেপিই যে সব থেকে বেশি চাঁদা পেয়েছিল, তা আগেই জানা গিয়েছিল। ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে মোট ১২,৭৬৯ কোটি টাকা চাঁদার প্রায় অর্ধেক, ৬০৬১ কোটি চাঁদা বিজেপি পেয়েছিল। মোট ১৬১০ কোটি টাকা পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে তৃণমূল। তবে এত দিন জানা ছিল না যে, কে কার থেকে কত টাকা পেয়েছে। অভিযোগ উঠেছিল, লোকসভা ভোটের মুখে বিজেপি কার থেকে কত টাকা চাঁদা পেয়েছে, তা প্রকাশ করতে চাইছে না। কিন্তু আজ স্টেট ব্যাঙ্ক সমস্ত তথ্য প্রকাশ করার পরে ধাপে ধাপে এই সমস্ত অঙ্ক ক্রমশ স্পষ্ট হবে বলে রাজনৈতিক মহলে ধারণা। যেমন দেখা যাচ্ছে, যে ১৮টি সংস্থা সব থেকে বেশি চাঁদা দিয়েছে, তাদের সকলের থেকেই টাকা পেয়েছে বিজেপি।
ব্যবসার জন্য যে বহু সংস্থাই কম-বেশি সংশ্লিষ্ট সমস্ত সংস্থাকে ‘খুশি’ রাখতে চেয়েছে, চাঁদার প্রাথমিক পরিসংখ্যানে তা স্পষ্ট। যেমন, হায়দরাবাদের সংস্থা মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং ৫৮৪ কোটি টাকা চাঁদা বিজেপিকে দিয়েছে। তেলঙ্গানার দল বিআরএস পেয়েছে ১৯৫ কোটি। ডিএমকে পেয়েছে ৮৫ কোটি টাকা। এর উত্তরপ্রদেশের শাখা সংস্থা আবার কংগ্রেসকে ১১০ কোটি টাকা চাঁদা দিয়েছিল। বিজেপিও ওই সংস্থার থেকে পেয়েছে ৮০ কোটি টাকা।কংগ্রেসের অবশ্য গোড়া থেকেই অভিযোগ, সরকারি বরাতের বিনিময়েই মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতোসংস্থার থেকে কোটি কোটি টাকা চাঁদার নামে ঘুষ আদায় করেছে বিজেপি। কংগ্রেসের প্রধান মুখপাত্র জয়রাম রমেশ বলেন, “২০১৮ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বিজেপি যে ৮ হাজার কোটি টাকার মতো চাঁদা পেয়েছে, তার মধ্যে ৪ হাজার কোটি চাঁদা প্রায় ৪ লক্ষ কোটি টাকা বরাত পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে বিভিন্ন সংস্থার থেকে আদায় করা হয়েছিল। আমরা এই যোগাযোগ চিহ্নিত করে ফেলেছি। শীঘ্রই তা প্রকাশ করা হবে।’’ জয়রামের অভিযোগ,ওষুধ সংস্থার থেকেও ছাড়পত্রের বিনিময়ে টাকা তুলেছে বিজেপি।
ফিউচার গেমিং, মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পরে চাঁদা দেওয়ার অঙ্কে তৃতীয় কুইক সাপ্লাই চেন নামে তুলনায় একটি অপরিচিত সংস্থা। এই সংস্থার সঙ্গে রিলায়্যান্সের যোগাযোগ রয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। কারণ, রিলায়্যান্স গোষ্ঠীর তিনটি সংস্থার হাতে কুইক সাপ্লাইয়ের ৫০ শতাংশ মালিকানা রয়েছে। রিলায়্যান্সের তরফে অবশ্য দাবি করা হয়েছিল, কুইক সাপ্লাই তাদের শাখা সংস্থা নয়। স্টেট ব্যাঙ্কের তথ্য বলছে, কুইক সাপ্লাই মোট ৩৭৫ কোটি টাকা চাঁদা দিয়েছিল বিজেপিকে। ২৫ কোটি টাকা চাঁদা পেয়েছিল শিবসেনা। বেদান্ত বিজেপিকে ২২৬ কোটি টাকা চাঁদা দিয়েছিল। এই সংস্থা কংগ্রেসকেও চাঁদা দিয়েছে ১০৪ কোটি টাকা।
স্টেট ব্যাঙ্কের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, তৃণমূলের তহবিলে মার্টিনের সংস্থার পরেই সব থেকে বেশি চাঁদা এসেছে হলদিয়া এনার্জির কাছ থেকে। এই সংস্থা তৃণমূলকে ২৮১ কোটি টাকা চাঁদা দিয়েছিল। বিজেপিও তাদের থেকে ৮১ কোটি চাঁদা পেয়েছে। কেভেন্টার ফুড পার্ক ইনফ্রা, এমকেজে এন্টারপ্রাইজ়েস, মদনলাল লিমিটেড—কলকাতার ঠিকানায় থাকা সংস্থা মোট ৫৭৩ কোটি টাকা চাঁদা বিলি দিয়েছিল। এর মধ্যে ৩৪৬ কোটি টাকাই পেয়েছে বিজেপি।
সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচনী বন্ডকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে খারিজ করার পরে স্টেট ব্যাঙ্ককে সমস্ত তথ্য প্রকাশের নির্দেশ দেয়। কিন্তু তার জন্য ভোটের পরে ৩০ জুন পর্যন্ত সময় চায় স্টেট ব্যাঙ্ক। সুপ্রিম কোর্ট তাতে রাজি না হওয়ায় স্টেট ব্যাঙ্ক দু’টি তথ্যভান্ডার প্রকাশ করে। একটিতে ছিল কে কবে কত টাকার বন্ড কিনেছেন। অন্যটিতে, কোন দল কবে বন্ড মারফত কত টাকাচাঁদা পেয়েছে। কিন্তু স্টেট ব্যাঙ্ক বন্ডগুলিকে চিহ্নিত করার সংখ্যা প্রকাশ করেনি। ফলে কোন দল কার থেকে কত টাকা পেয়েছে, তা বোঝা যাচ্ছিল না। সুপ্রিম কোর্টের ‘ধমকে’ আজ স্টেট ব্যাঙ্ক সমস্ত তথ্য প্রকাশ করেছে।
সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির প্রশ্ন, ‘‘জুনের আগে এই তথ্য প্রকাশ করা সম্ভব নয় বলার পরে স্টেট ব্যাঙ্ক সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সব তথ্য প্রকাশ করেছে। যার অর্থ, সুপ্রিম কোর্টকে স্টেট ব্যাঙ্ক এর আগে অসত্য বলেছিল। কার চাপে, তা অনুমান করাই যায়! এখন কি স্টেট ব্যাঙ্কের বিরুদ্ধে হলফনামা গিয়ে অসত্য বলার অভিযোগে মামলা করা উচিত নয়?”