(বাঁ দিকে) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শওকত মোল্লা (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ‘সতর্কবার্তা’ পাঠিয়েছেন। তিনি আরও এক ধাপ এগিয়ে তাকে ‘নির্দেশ’ বলে মনে করছেন। তিনি তৃণমূলের ‘ডাকাবুকো’ বিধায়ক শওকত মোল্লা, যিনি ভাঙড় বিধানসভা কেন্দ্রে দলের পর্যবেক্ষক। ভাঙড় বিধানসভা আসনটি অবশ্য তৃণমূলের দখলে নেই আর। গত বিধানসভা ভোটে সেটি জিতে নিয়েছেন আইএসএফের নওশাদ সিদ্দিকি। কিন্তু ভাঙড়ে শওকতের ‘দাপট’ অনস্বীকার্য।
প্রসঙ্গত, এর আগেও প্রকাশ্যে শওকতকে ‘হুঁশিয়ারি’ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ক্যানিং পূর্ব আসন থেকে তৃণমূলের প্রতীকে জয়ী হয়ে বিধায়ক হন শওকত। তার পর দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তাঁর বিধানসভা কেন্দ্রের জীবনতলায় একটি বাস টার্মিনাসের দাবি করেন তিনি। জবাবে মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্যেই তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘শওকত, তুই তো মারপিট করিস! বোম বাঁধিস!’’ মুখ্যমন্ত্রীর ওই মন্তব্যের পরে বিরোধী শিবির তো বটেই, তৃণমূলেরও একাংশে প্রশ্ন উঠেছিল, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী যদি শওকত সম্পর্কে এমন মন্তব্য করেন, তা হলে তাঁকে কেন গ্রেফতার করা হবে না? যদিও বিষয়টি আর এগোয়নি। তবে ইনফোসিসের মঞ্চ থেকে যে ভাবে মমতা স্বয়ং শওকতের নাম করে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, তাতে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূল মনে করছে, শওকতকে আরও ‘সংযমী’ হতে হবে।
বুধবার ভাঙড় সংলগ্ন হাতিশালায় তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা ইনফোসিসের নতুন ক্যাম্পাস উদ্বোধন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। সেই মঞ্চ থেকেই সরাসরি তিনি ক্যানিং পূর্ব বিধানসভা কেন্দ্রের তৃণমূল বিধায়ক শওকতকে সতর্কবার্তা পাঠিয়েছেন। মমতা বলেছেন, ‘‘শওকতকে বলব, সব ধরনের সহযোগিতা করতে। পুলিশকে সতর্ক থাকতে হবে। ইনফোসিসকে কেউ যেন কোনও ভাবে বিরক্ত করতে না পারে! বিধাননগর পুলিশ এবং রাজ্য পুলিশ যৌথ সমন্বয়ে সংস্থার নিরাপত্তার দিকটি নজরে রাখবে।’’ দলীয় বিধায়ককে উদ্দেশ করে মমতার ওই মন্তব্যের পর খানিক শোরগোল উঠেছে। সঙ্গে প্রশ্ন, মমতা কি শওকতকে সতর্ক করে দিয়ে এটাই বলতে চেয়েছেন যে, হাতিশালায় বিনিয়োগ করার পরে ইনফোসিস যেন তৃণমূলের স্থানীয় নেতৃত্বের ‘দাদাগিরি’র মুখে না পড়ে!
এমনিতেই রাজনৈতিক সংঘর্ষের নিরিখে ভাঙড়ের নাম উপর দিকে রয়েছে। আইএসএফ বনাম তৃণমূল লড়াইয়ে বোমাবাজি বা গুলিচালনার ঘটনা সেখানে খুব ‘অস্বাভাবিক’ নয়। তার সঙ্গেই রয়েছে শাসকদলের গোষ্ঠীলড়াই। একদা ভাঙড়ের ‘তাজা নেতা’ আরাবুল ইসলাম অবশ্য এখন অনেকটাই ‘নিষ্প্রভ’। ভাঙড়ের রাজনীতিতে শওকতের প্রবল পরাক্রান্ত প্রতিদ্বন্দ্বী প্রাক্তন বিধায়ক আরাবুল সম্প্রতি হাই কোর্টে জামিন নিয়ে এলাকায় ফিরেছেন। কিন্তু তিনি ‘নিষ্প্রভ’ হলেও ‘নিশ্চিহ্ন’ নন। আর আরাবুল আগের মেজাজে না-থাকলেও তৃণমূলে গোষ্ঠীকোন্দলের জমানা শেষ হয়নি। ভাঙড়ের লাগোয়া হাতিশালায় ইনফোসিসের নতুন ক্যাম্পাস হয়েছে। ভাঙড়ে ‘অশান্তি’ হলে তার ছাপ যে হাতিশালার ক্যাম্পাসে গিয়ে পড়বে, তা নিয়ে কারওরই কোনও সন্দেহ নেই।
এই সব বিষয় নজরে রেখেই মমতা শওকতের প্রতি ‘সতর্কবার্তা’ পাঠিয়েছেন। অশান্তির অভিযোগ যাঁর বিরুদ্ধে বিরোধীরা করে থাকেন, তাঁকে দায়িত্ব দিয়েছেন গোলমাল যাতে না-হয়, সে দিকে নজর রাখতে। অর্থাৎ, ক্লাসের সবচেয়ে ‘দুষ্টু’ বলে পরিচিত ছাত্রকে ‘মনিটর’ করে দিয়েছেন।
‘মনিটর’ অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারিকে তাঁর ‘আদেশ’ হিসেবেই দেখছেন। ক্যানিং পূর্বের তৃণমূল বিধায়ক বৃহস্পতিবার বলেন, ‘‘দিদি আমাদের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি যে দায়িত্ব আমাকে দেবেন, সেই দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করব। ভাঙড় এলাকায় তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা বিনিয়োগে করতে আসছে। তাই এলাকা শান্ত রাখতে হবে। শান্তি ফিরলেই সুষ্ঠু ভাবে বিনিয়োগ আসবে এবং রাজ্য এগোবে।’’
তবে এই বক্তব্যের সঙ্গেই অশান্তি প্রসঙ্গে আরাবুলকে টেনে এনেছেন শওকত। আরাবুলের উদাহরণ দিয়ে তৃণমূল বিধায়ক বলছেন, ‘‘এখন আরাবুল ইসলামের মতো নেতারা ভাঙড়ের রাজনীতিতে নেই বললেই চলে। তাই ভাঙড়ে তোলাবাজি, জুলুমবাজি, সিন্ডিকেটের মতো বিষয় আর হয় না। তা ছাড়া কলকাতা পুলিশের আওতায় আসার পর ভাঙড়ের আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হয়েছে। এলাকায় শান্তি বিরাজ করছে। তাই ইনফোসিস নিয়ে দিদি আমাকে যে নির্দেশ দিয়েছেন, তা পালন করতে আমার কোনও অসুবিধা হবে না।’’ আর যাঁকে ‘নিশানা’ করে ভাঙড়ে অশান্তির অভিযোগ তুলছেন শওকত, সেই আরাবুল বলছেন, ‘‘এ সব বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই।’’