শুভেন্দু অধিকারী ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।
টানা দু’ঘণ্টার বৈঠক হল। এক দিকে শুভেন্দু অধিকারী। অন্য দিকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তার পরেও বরফ গলল কি? তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের দাবি, সমস্যা মিটে গিয়েছে। শুভেন্দুর তরফ থেকে যদিও সে ব্যাপারে কিছুই বলা হল না।
বৈঠকের মাঝে অভিষেকের ফোন থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা শুভেন্দু অধিকারীর। অভিষেকের তরফে ‘আন্তরিক ভাবে’ একসঙ্গে দল চালানো এবং কাজ করার আহ্বান। দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতার তরফেও একসঙ্গে সকলে মিলে দল চালানোর কথা। মঙ্গলবার রাতে এই দু’টি কথোপকথনে কি রাজ্য রাজনীতির মোড় ঘুরল? এখনও তা নিশ্চিত করে বলার সময় আসেনি। তবে প্রবীণ তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়ের সেটাই দাবি। একই রকম আশাবাদী গোটা তৃণমূল শিবিরও। কারণ, যুযুধান দু’পক্ষ অভিষেক-শুভেন্দুর অবশেষে মুখোমুখি আলোচনায় বসা। এবং পাশাপাশিই অবশেষে ফোনে হলেও বেশ কয়েকমাস পর মমতা-শুভেন্দু কথা।
মঙ্গলবার রাতে উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারের কাছে একটি বাড়িতে ওই বৈঠকে অভিষেক, শুভেন্দু ছাড়াও ছিলেন তৃণমূলের দুই সাংসদ সৌগত এবং সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ছিলেন তৃণমূলের ভোট কৌশলী প্রশান্ত কিশোরও। অর্থাৎ, একদিকে মুখোমুখি বিবদমান দু’পক্ষ। অন্যদিকে, দুই ‘নিরপেক্ষ’ প্রবীণ নেতা। বৈঠকের পর সৌগত দবি করেন, ‘‘সমস্ত সমস্যা মিটে গিয়েছে। শুভেন্দু জানিয়েছে, ও দল ছাড়ছে না। বিধায়ক পদও ছাড়ছে না। বাকি শুভেন্দুই পরে জানাবে।’’ যদিও মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত এ ব্যাপারে শুভেন্দুর কোনও বক্তব্য জানা যায়নি।
মঙ্গলবার গভীর রাত শুভেন্দুর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাঁর সাড়া মেলেনি। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্রের খবর, ‘রফাসূত্র’ মিলেছে যে পথে, সেটি হল— শুভেন্দু যে পাঁচটি জেলার পর্যবেক্ষক ছিলেন, সেগুলির প্রার্থী বাছাই নিয়ে অভিষেক বা প্রশান্ত তেমন ভাবে কোনও হস্তক্ষেপ করবেন না। প্রসঙ্গত, ওই বিষয়টি নিয়েই শুভেন্দুর সবচেয়ে আপত্তি ছিল। বৈঠকে শুভেন্দু জানিয়েছেন, তিনি বা তাঁরা একজনকে দেখেই (মমতা) দল করেন। বাকি কারও নির্দেশ বা হস্তক্ষপ তাঁর পক্ষে মানা কঠিন। সূত্রের খবর, বৈঠকের শুরুতেই অভিষেক শুভেন্দুর হাত জড়িয়ে বলেন, সকলে মিলে একসঙ্গে দল চালানো হোক। দলের ভালর জন্য নির্বাচনের আগে এখন সেটাই করা উচিত। তাঁরা সকলেই দলকে ভালবাসেন। দলের জয়টাই এখন মুখ্য।
আরও পড়ুন: টেলিপ্রম্পটার দেখে বক্তৃতা করি না, মোদীকে খোঁচা মমতার
তার পরেই অভিষেক তাঁর নিজের ফোন থেকে মমতার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন শুভেন্দুকে। সূত্রের খবর, মমতা শুভেন্দুকে বলেন, সামনে কঠিন নির্বাচন। এখন সকলে মিলে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। মমতা শুভেন্দুকে আরও বলেন, আগামী ৭ ডিসেম্বর মেদিনীপুরে তাঁর সভা আছে। সেই সভায় পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরের সমস্ত তৃণমূল বিধায়ককে আসতে বলা হয়েছে। শুভেন্দুও যেন ওই সভায় আসেন। শুভেন্দু তার জবাবে কী বলেছেন, তা রাত পর্যন্ত জানা যায়নি। তবে তিনি পরের কয়েকদিনে কী করেন এবং মেদিনীপুরে যান কি না, তার দিকে গোটা রাজ্য আগ্রহভরে তাকিয়ে থাকবে।
আরও পড়ুন: তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রকে আরও জমি, আরও ৪ লক্ষ কর্মসংস্থান, আশ্বাস মুখ্যমন্ত্রীর
বৈঠকের পর গোটা ঘটনায় মধ্যস্থতাকারী সৌগত বলেছেন, ‘‘আমরা সকলেই দলকে ভালবাসি। একসঙ্গে সকলে দল করতে চাই। দু’জনকেই (অভিষেক-শুভেন্দু) আমি খবর দিয়েছিলাম। দু’জনের একসঙ্গে বসার প্রয়োজন ছিল। সেটা হওয়ায় সব মিটে গিয়েছে। বৈঠক ভাল হয়েছে।’’ শুভেন্দুর বাবা তথা তৃণমূল সাংসদ শিশির অধিকারীও বলেছেন, ‘‘সমস্যা ছিল। তবে সমস্যা মিটে গেলে ভাল। তাতে দলের ভাল হবে।’’ তৃণমূলেরই সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় লাগাতার শুভেন্দুকে আক্রমণ করছিলেন। মঙ্গলবারের বৈঠকের পর কল্যাণও বলেছেন, ‘‘এর চেয়ে ভাল খবর আর কিছু হতে পারে না। আমি এই বৈঠককে স্বাগত জানাচ্ছি।’’ কল্যাণ আরও জানিয়েছেন, তিনি আর অতীতের পুনরাবৃত্তি চন না। তাঁর অতীতের মন্তব্যের ময়নাতদন্তও করতে চান না।
মঙ্গলবার রাতে যে বৈঠক হতে চলেছে, তা তৃণমূলের শীর্ষনেতৃত্ব জানতেন। ঠিক ছিল, বিষয়টি যথাসম্ভব গোপনে রাখা হবে। সেটা এতটাই কঠোর ভাবে মানা হয়েছিল যে, বিদ্যাসাগর সেতুর টোল প্লাজা পর্যন্ত এসে সংবাদমাধ্যমকে অপেক্ষারত দেখে (আগের থেকেই খবর পাওয়া গিয়েছিল যে, শুভেন্দু কলকাতার দিকে রওনা দিয়েছেন) গাড়ি ঘুরিয়ে আবার কোনা এক্সপ্রেসওয়ের দিকে চলে যান। সূত্রের খবর, তিনি বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে ধরে অন্য রাস্তা দিয়ে শহরে ঢোকেন। উত্তর কলকাতার যে বাড়িতে বৈঠক হওয়ার কথা ছিল, শুভেন্দু সেখানে পৌঁছনোর পর একে একে পৌঁছন অভিষেক, প্রশান্ত কিশোর, সৌগত এবং সুদীপ। তার পরেই বৈঠক শুরু হয়। যা শেষ হওয়ার পর তৃণমূলের শীর্ষনেতৃত্বের দাবি, সমস্যা মিটে গিয়েছে।
আরও পড়ুন: পিকে-র বিরুদ্ধে ক্ষোভ, শীলভদ্র দত্তের দেখা পেলেন না জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক
এখন দেখার, যে পাঁচটি জেলায় শুভেন্দু পর্যবেক্ষক ছিলেন, সেগুলির প্রার্থী তাঁকে মনোনীত করতে দেওয়া হয় কি না। মঙ্গলবার রাতে তৃণমূলের এক অন্যতম শীর্ষনেতা জানিয়েছেন, সকলে মিলেই প্রার্থিতালিকা ঠিক করা হবে। ওই নেতার কথায়, ‘‘প্রতিবারের মতো আমরা সকলে মিলেই প্রার্থী বেছে নেব। ওটা নিয়ে এরপর আর কোনও সমস্যা হবে না।’’ অর্থাৎ, ওই পাঁচটি জেলায় প্রার্থী বাছাইয়ে শুভেন্দুর মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। সূত্রের খবর, দলনেত্রী মমতাও গোটা ঘটনাপ্রবাহে খুশি এবং আশাবাদী। এখন দেখার, বুধবার বা তার পরে শুভেন্দু কী বলেন বা আদৌ কিছু বলেন কি না। দেখার এ-ও যে আগামী সোমবার, ৭ ডিসেম্বর তিনি মমতার সভায় যান কি না।
প্রসঙ্গত, গত শুক্রবার শুভেন্দু মন্ত্রিত্বে ইস্তফা দেওয়ার পর দ্রুত জল গড়াতে থাকে। সৌগত অবশ্য বরাবরই চেষ্টা চালাচ্ছিলেন সমস্যা সমাধানের জন্য। মূলত তাঁর আগ্রহেই সমাধানের দরজা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি। শেষপর্যন্ত মন্ত্রিত্ব ছাড়ার তিনদিন পরেই যুযুধান দু’পক্ষের বৈঠক হল।