আদালতের পথে দিবাকর। ছবি: পার্থপ্রতিম দাস
তিনি শাসকদলের ডাকাবুকো নেতা। বিতর্কেও জড়িয়েছেন বারবার। সেই দিবাকর জানা নিজে থানায় এসে আত্মসমর্পণ করায় শোরগোল পড়েছে পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা রাজনীতিতে। দু’দিন ধরে পালিয়ে বেড়ানোর পরে হঠাৎ কেন এই আত্মসমর্পণ, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে।
কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের এক আধিকারিককে মারধর করার ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত হিসেবেই রবিবার আত্মসমর্পণ করেছেন দিবাকর। ঘটনার পরেই অবশ্য তাঁকে সাসপেন্ড করেছে তৃণমূল। এ দিন যদিও সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে দলের বিরুদ্ধে কিছু বলেননি দিবাকর। উল্টে দলের প্রতি আস্থা জানিয়েছেন। তাই তৃণমূলের অন্দরে একাংশের ব্যাখ্যা, দলে কোণঠাসা হয়ে পড়ায় আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়েছেন দিবাকর।
কিন্তু রাজনৈতিক মহলের একাংশ মনে করিয়ে দিচ্ছেন, দিবাকর তো আগেও সাসপেন্ড হয়েছে। পরে দল তাঁকে ফিরিয়েও নিয়েছে। তিনি ফিরেছেন স্বমহিমায়। ফলে, সাসপেনশনের ভয়ে তাঁর আত্মসমর্পণের তত্ত্ব ততটা জোরাল নয়। সে ক্ষেত্রে উঠে আসছে ‘ভাবমূর্তি’র ব্যাখ্যা। মনে করা হচ্ছে, দলের বাইরে জনপ্রতিনিধি হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি উদ্ধারেই এ দিন দিবাকরের আত্মসমর্পণ। এমনকি জামিনের আবেদনও করেননি তিনি। আদালত তাঁকে জেল হেফাজতে পাঠিয়েছে।
এ দিন আদালতে তোলার সময় দিবাকর নিজেও বলেন, ‘‘অভিযোগ উঠতেই পারে। তবে আমি একজন রাজনৈতিক নেতা ও পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি। দলের জন্মলগ্ন থেকে আমি তৃণমূল করছি। অনেক মানুষের উপকার করেছি, বহু কাজ করেছি। দলের প্রতি পূর্ণ আস্থা রয়েছে। ভবিষ্যতে দল যাতে শক্তিশালী হয় সে জন্য পিছন থেকে যা করার সবই করব।’’
নন্দীগ্রামে জমি আন্দোলনের জেরে জেলায় বাম জমানার যখন শেষ-পর্ব, কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে তৃণমূল শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা হিসেবে দিবাকরের রাজনৈতিক উত্থান শুরু। ক্রমে শ্রমিক নেতার গণ্ডী ছাড়িয়ে শহিদ মাতঙ্গিনী ব্লকে দলের নেতৃত্বের রাশ আসে তাঁর হাতে। রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের পরে ২০১৩ সালে প্রথমে জেলাপরিষদ সদস্য ও পরে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি হন তিনি। ঢুকে পড়েন প্রশাসনিক ক্ষমতার বৃত্তে। শাসকদলের নেতা বিতর্কে কখনও পিছু ছাড়েনি দাপুটে দিবাকরের। এলাকায় সবাই তাঁকে লালু নামে এত ডাকেই চেনে। বিভিন্ন সময় নানা অপ্রীতিকর ঘটনায় তাঁর নাম জড়িয়েছে। শেষমেশ গত সপ্তাহে কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের আধিকারিককে মারধরের ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর হতেই দিবাকরকে সাসপেন্ড করেন তৃণমূল জেলা নেতৃত্ব। তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যকরী সভাপতি পদ থেকেও। দিবাকরের বন্দুকের লাইসেন্স বাতিল করে থানায় জমার নির্দেশ দেয় জেলা প্রশাসন। আর বৃহস্পতিবার রাতে গ্রেফতার হন দিবাকরের ঘনিষ্ঠ শহিদ মাতঙ্গিনী পঞ্চায়েত সমিতির কৃষি কর্মাধ্যক্ষ গৌরহরি মাজি। ফলে, চাপের মুখে নতিস্বীকারের তত্ত্ব সামনে আসছে।
যদিও দিবাকরের ঘনিষ্ঠদের একাংশের মতে, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের শ্রমিক নেতার পরিচয় ছাড়াও তিনি বিভিন্ন পদে রয়েছেন। জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তাঁর নিজস্ব একটা ভাবমূর্তি রয়েছে। আর সেই পরিচয় ‘নষ্ট’ করতে নারাজ দিবাকর। তাই প্রথমে উচ্চ আদালতে আগাম জামিনের আবেদন করার পরিকল্পনা থাকলেও শেষমেশ আত্মসমর্পণই করেন দিবাকর। জানা গিয়েছে, আইনজীবীরা তাঁকে পরামর্শ দেন, পুলিশ গ্রেফতার করলে দুষ্কৃতীর ‘তকমা’ লাগতে পারে। আর তাতে নষ্ট হবে তাঁর রাজনৈতিক নেতার ‘ভাবমূর্তি’।
যে অঙ্কেই আত্মসমর্পণ হোক না কেন, দিবাকরের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের দিকেই এখন তাকিয়ে নন্দীগ্রামের জেলা।