ডায়মন্ড হারবারের গণ্ডি ছাড়িয়ে গোটা রাজ্যেই কি তাঁর প্রভাব বিস্তার করছেন অভিষেক? — ফাইল চিত্র।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার পরিচালনায় কি ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছায়া? রাজ্যের প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক বৃত্তে এমন আলোচনা এবং তজ্জনিত প্রশ্ন ছিলই। ঘটনা পরম্পরায় সেই গণ্ডি ছাড়িয়ে এই জল্পনা শুরু হয়েছে আমজনতার একটি বড় অংশের মধ্যেও। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা সাংসদ অভিষেক সরকারি প্রকল্প উদ্বোধন করছেন, মানুষ বিপন্ন হয়ে তাঁর ‘টিম’-এর সঙ্গে যোগাযোগ করলে অভিষেক নিজেই সংশ্লিষ্ট দফতরের মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে সুরাহার ব্যবস্থা করছেন। সে কথা নিজের টুইটার হ্যান্ডলে জানিয়েও দিচ্ছেন।
জল্পনা আরও যে, ‘দিদিকো বলো’-র ধাঁচেই ‘এক ডাকে অভিষেক’ বলে যে হেল্পলাইন নম্বর চালু করেছেন তৃণমূলের অলিখিত দু’নম্বর নেতা, তার মাধ্যমে তিনি কার্যত একটি সমান্তরাল সরকার পরিচালনার উদ্যোগ শুরু করেছেন। যার সর্বশেষ উদাহরণ হল বুধবার রাতে উত্তরবঙ্গ থেকে ঝড়বৃষ্টিতে বিদ্যুৎবিভ্রাটের খবর পেয়ে সরাসরি বিদ্যুৎমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসকে ফোন করে দ্রুত সুরাহার ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দেওয়া। এবং কালক্ষেপ না-করে বিষয়টি টুইটারে জানিয়েও দেওয়া।
এরই পাশাপাশি মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা বিপাকে পড়লেও দ্রুত তাঁর দফতরকে সেই সমস্যার সমাধান করার নির্দেশ দিচ্ছেন অভিষেক। তাতে কাজও হচ্ছে।
২০১১ সালের ২১ জুলাই শহিদ দিবসের মঞ্চ থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে রাজনীতির পথে চলা শুরু করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভ্রাতুষ্পুত্র। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে সোমেন মিত্রের ছেড়ে যাওয়া ডায়মন্ডহারবার আসনে তাঁকে প্রার্থী করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কথিত যে, তাতে দলের একটি অংশের সামান্য আপত্তিও ছিল। তাঁদের যুক্তি ছিল, অভিষেক তখন বয়সে নবীন। তখনই তাঁকে লোকসভায় মনোনয়ন দেওয়া ঠিক হবে না। মমতা সেই আপত্তি গ্রাহ্য করেননি। প্রথম বার ভোটে দাঁড়িয়েই ৭১ হাজার ভোটে জয় পেয়েছিলেন অভিষেক। ওই বছরই অক্টোবর মাসে তিনি দায়িত্ব পান দলের যুব সংগঠনের সভাপতির। যে বিষয়টি নিয়ে তাঁর সঙ্গে শুভেন্দু অধিকারীর প্রথম সংঘাত বেধেছিল। এর পর কয়েক বছর অভিষেক নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতেন নিজের লোকসভা কেন্দ্র ও যুব সংগঠনের মধ্যেই।
কিন্তু তার পর থেকে ধীরে ধীরে সামগ্রিক ভাবে দল ও পরে সরকারে সপ্রতিভ উপস্থিতি লক্ষ্য করা গিয়েছে তাঁর। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের তৃতীয় বার জয়ের পরেই অভিষেকের প্রভাব দ্রুতগতিতে বাড়তে শুরু করেছে। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের পর তাঁকে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের পদে নিয়োগ করেন মমতা। তার পর থেকে আরও ‘সক্রিয়’ হন অভিষেক। প্রশাসনে তাঁর প্রথম পদক্ষেপ ছিল ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় ডায়মন্ড হারবারে। নিজের লোকসভা কেন্দ্রের পরিস্থিতি অভিষেক যেভাবে সামলেছিলেন, তা গোটা রাজ্যেই ‘মডেল’ হওয়া উচিত বলে দাবি করেছিলেন তাঁর অনুগামীরা। সেই মডেলের নামও দেওয়া হয়েছিল ‘ডায়মন্ড হারবার মডেল’। নিজের লোকসভা কেন্দ্রের জন্য একটি হেল্পলাইন নম্বর চালু করেছিলেন অভিষেক। তারই নাম ‘এক ডাকে অভিষেক’। যেখানে ডায়মন্ডহারবার লোকসভা এলাকার বাসিন্দারা নিজেদের অভাব অভিযোগের কথা জানাতেন এবং তার সমাধান করা হত।
পর্যায়ক্রমে সেই হেল্পলাইন নম্বরটিও ডায়মন্ড হারবারের গণ্ডি ছাড়িয়ে যায়। কোচবিহার, কাঁথি, কেশপুর, মালবাজার ও রানাঘাট-সহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক জনসভায় ‘এক ডাকে অভিষেক’ হেল্পলাইনের নম্বর দিয়ে আমজনতাকে তাঁদের অভাব অভিযোগের কথা সেখানে জানাতে বলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। সেই নম্বরে যে কোনও ধরনের সমস্যার কথা জানিয়ে ফোন করলে সুফল মিলেছে বলেই দাবি তৃণমূল নেতৃত্বের।
হেল্পলাইনে ফোন করে উচ্চ মাধ্যমিকের অ্যাডমিট কার্ড হাতে পেয়েছেন খড়্গপুরের ছাত্রী সোনালী মিদ্যা। বুধবার ঝড়বৃষ্টির ফলে জলপাইগুড়ি, কোচবিহার এবং আলিপুরদুয়ারের বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন এলাকাগুলির বাসিন্দারাও সমাধানের জন্য ফোন করেছিলেন ‘এক ডাকে অভিষেক’ হেল্পলাইনেই। অভিষেক মন্ত্রীকে ফোন করে সমস্যা সমাধানের নির্দেশ দিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, দক্ষিণবঙ্গে যাতে ওই ধরনের কোনও পরিস্থিতি তৈরি না-হয়, তার আগাম সতর্কতা হিসেবে বিদ্যুৎমন্ত্রী অরূপ বৃহস্পতিবার তাঁর দফতরের আধিকারিকদের নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসেছেন।
গত বছর মালবাজারে দলের শ্রমিক সংগঠন আয়োজিত সভাতে শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটককে চা বাগানের শ্রমিকদের জন্য পরিচয়পত্র তৈরি করে দেওয়ার পাশাপাশি মহিলা শ্রমিকদের সাহায্যার্থে তাঁদের বাচ্চাদের জন্য ‘ক্রেশ’ তৈরির উদ্যোগ নিতে বলেছিলেন অভিষেকই। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সেই কাজ করেছিল শ্রম দফতর। উত্তরবঙ্গের নদীগুলির বিষয়ে একই নির্দেশ অভিষেক দিয়েছিলেন সেচমন্ত্রী পার্থ ভৌমিককেও।
শুধু তা-ই নয়, সরকারি প্রকল্পের উদ্বোধনও করতে শুরু করেছেন অভিষেক। এমনিতে তিনি সরকারি কর্মসূচিতে থাকেন না। কিছুদিন আগে উত্তরবঙ্গে একটি প্রশাসনিক সভার মঞ্চে তাঁকে ডেকেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। অভিষেক স্রেফ সভায় কয়েক মিনিটের জন্য উঠে জনতাকে নমস্কার জানিয়ে নেমে যান। তাঁর বসার জন্য মঞ্চে চেয়ার এগিয়ে দেওয়া হয়েছল। অভিষেক বসেননি। বস্তুত, মমতা নিজেই বলেছিলেন, ‘‘ও আসতে চাইছিল না। আমিই বলেছি, তুমি যখন এখানে আছো, তখন এক বার মঞ্চে উঠে সকলকে নমস্কার করে যাও। তা-ই ও এসেছে।’’ কিন্তু সম্প্রতি চড়িয়াল খালের ওপর তৈরি নবনির্মিত সেতুর উদ্বোধন করেছেন অভিষেক। যা একটি সরকারি প্রকল্প। সাধারণত সরকারি প্রকল্পের উদ্বোধনে থাকেন সংশ্লিষ্ট দফতরের মন্ত্রী। এলাকার জনপ্রতিনিধি হিসেবে সাংসদ বা বিধায়কেরা আমন্ত্রিত হিসেবে মঞ্চে থাকেন। আগামী ২৭ মার্চ আমতলা এলাকায় একটি বাস টার্মিনাসের উদ্বোধন হবে। টার্মিনাসটি তৈরি করেছে পূর্ত দফতর। তার রক্ষণাবেক্ষণ থেকে শুরু করে পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে পরিবহণ দফতর। কিন্তু সেটির উদ্বোধন করবেন সাংসদ অভিষেকই।
তৃণমূলের একটি অংশ অবশ্য বলছেন, দু’টি প্রকল্পই অভিষেকের ডায়মন্ড হারবার এলাকার অন্তর্ভুক্ত। এবং অভিষেক সরকার পক্ষেরই সাংসদ। তাই তিনি তাঁর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত যে কোনও সরকারি প্রকল্পের উদ্বোধন করতেই পারেন।
প্রসঙ্গত, ২০১১ সালের ক্ষমতায় আসার পর থেকে জেলায় জেলায় গিয়ে প্রশাসনিক বৈঠক শুরু করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। সেই একই ধাঁচে সাংসদ অভিষেক ডায়মন্ড হারবার এলাকার সরকারি কাজের পর্যালোচনা করতে নিয়মিত প্রশাসনিক বৈঠক করেন। প্রত্যাশিত ভাবেই বিরোধী বিজেপি অভিযোগ তুলেছে, একজন সাংসদ তাঁর লোকসভা এলাকা নিয়ে প্রশাসনিক বৈঠক করতে পারেন কি না। প্রত্যাশিত ভাবেই সেই অভিযোগে কান দেননি সাংসদ অভিষেক। কয়েক মাস অন্তর ডায়মন্ড হারবারে প্রশাসনিক বৈঠক করেন তিনি।
কিন্তু দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাপ্রবাহে দেখা যাচ্ছে, অভিষেক ডায়মন্ড হারবারের গণ্ডি ছাড়িয়ে গোটা রাজ্যেই তাঁর প্রভাব বিস্তার করছেন। তাঁর কাছে অভাব-অভিযোগ জানানলে দ্রুত সুরাহা মিলবে, এমন ধারনাও জনমানসে তৈরি হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। তৃণমূলের একটি অংশের বক্তব্য, যত দিন যাবে, ততই এই প্রক্রিয়া আরও বিস্তার লাভ করবে। ততই প্রশাসনে এবং সরকারি পরিচালনায় আরও লম্বা হয়ে পড়বে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছায়া।