বারাবনিতে মনোনয়ন দিতে আসা বিজেপি নেতার হাতে গোলাপ ফুল এবং জলের বোতল তুলে দেন তৃণমূলের এক নেত্রী। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
২০২৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন পর্ব শুরু হয়েছে গত শুক্রবার। মনোনয়ন জমা দেওয়ার প্রথম ৩ দিনে, অর্থাৎ সোমবার পর্যন্ত দু’রকম ছবি ধরা পড়েছে বাংলায়। এক, বিরোধীরা মনোনয়ন জমা দিতে গেলেই তেড়ে আসছেন শাসক দলের নেতা-কর্মী এবং সমর্থকেরা। বিরোধীরা যাতে বিডিও অফিসে ঢুকতে না পারেন, সে জন্য সরকারি অফিসের সামনে ‘আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে পাহারা’ দিতে দেখা গিয়েছে তৃণমূল নেতাদের। কোথাও থান ইট তো কোথাও লাঠি হাতে দেখা যাচ্ছে শাসকদলের প্রতিনিধিদের। দুই, বিরোধীরা যাতে সুষ্ঠু এবং সুস্থ ভাবে মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেন, তার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন শাসকদলের নেতারাই। পঞ্চায়েত ভোটের আগে হিংসা এবং সৌজন্য, দু’ধরনের চিত্রই ধরা পড়ছে বাংলার। বিরোধীদের অবশ্য অভিযোগ, প্রথম ছবিটাই প্রকট। দ্বিতীয়টি ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’-এর চেষ্টা। অন্য দিকে, শাসকদল প্রথম ছবিটিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেই ব্যাখ্যা করছে। কিন্তু ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটের সঙ্গে ২০২৩ সালের ছবির কোনও পরিবর্তন হল কি?
২০১৮ সালে নির্বাচনের আগেই পঞ্চায়েতে ২০ হাজারের বেশি আসনে জয়ী হয় তৃণমূল। পঞ্চায়েতের ৩টি স্তর মিলিয়ে প্রায় ৩৪ শতাংশ আসনে ছিলেন শুধু শাসকদলের প্রার্থী। যা রাজ্যের পঞ্চায়েত ভোটের ইতিহাসে ‘রের্কড’। রাজ্যে ‘লাগামছাড়া হিংসা’র অভিযোগ উঠেছিল শাসকদলের বিরুদ্ধে। বিরোধীরা অভিযোগ করে, তাদের মনোনয়ন জমা দিতে দেওয়া হয়নি। কোথাও মনোনয়ন জমা দিলেও তা প্রত্যাহার করিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তার উপর ভোটের সময়ও রক্ত ঝরেছে। উঠেছে রাজ্য পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন।
তবে ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটকে হিংসামুক্ত করার ‘অঙ্গীকার’ শোনা গিয়েছে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায়। এক বার নয়, দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বার বার শান্তির বার্তা দিয়েছেন তিনি। সেই বার্তা কতটা কার্যকরী হল, মনোনয়ন পর্বের তৃতীয় দিনে তার পর্যালোচনা করা সহজ নয়। তবে গত পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন পর্বের থেকে এ বারের পর্ব যে খানিকটা অন্য রকম, তা বলাই যায়। অন্তত, তৃণমূলের একটি বড় অংশই শীর্ষ নেতৃত্বের বার্তা পালনের চেষ্টা করছেন। তাই পশ্চিম বর্ধমানের বারবনিতে দেখা গিয়েছে, মনোনয়ন জমা দিতে আসা বিরোধীদের হাতে গোলাপ ফুল, জলের বোতল দিচ্ছেন তৃণমূল নেতারা। মনোনয়ন জমা দেওয়ার পর বিরোধী নেতারা যাতে চা খেয়ে যান, ছিল সেই আমন্ত্রণও। একই রকম ছবি দেখা গিয়েছে, পূর্ব বর্ধমানের ভাতারেও। তার উল্টো দিকেই রয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বজবজ, ভাঙড় কিংবা উত্তর ২৪ পরগনার মিনাখাঁর ছবি। যেখানে বিরোধীদের মনোনয়ন জমা দিতে বাধা দেওয়া হয়। অভিযোগ, এ সব জায়গায় শাসকদলের ‘বাহিনী’র হাতে ছিল লাঠি এবং অস্ত্রও।
অভিযোগ যেন না আসে
আসানসোলের বারাবনি বিধানসভার বারাবনি ব্লকে মনোনয়নের প্রথম দিন শাসকদলের বিরুদ্ধে লাঠি উঁচিয়ে মারধরের অভিযোগ করেছে বিরোধীরা। তবে ওই বিধানসভারই অন্য একটি ব্লকে দেখা গিয়েছে অন্য ছবি। সালানপুর ব্লকে মনোনয়ন কেন্দ্রের বাইরে তৃণমূলের নেতা এবং কর্মীরা বিজেপি, সিপিএম এবং কংগ্রেস প্রার্থীদের হাতে গোলাপ ফুল, পানীয় জলের বোতল ধরিয়ে দেন। আবার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর তাঁরা যেন বিডিও অফিসের ক্যান্টিন থেকে চা খেয়ে যান, তারও আমন্ত্রণ করেন তৃণমূল নেতারা। এ নিয়ে তৃণমূলের ব্লক সভাপতি ভোলা সিংহের কথায়, ‘‘এই ব্লকে কোনও ঝামেলা বা দ্বন্দ্ব হবে না। আমরা সবাই চাই, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন। তাই সবাই সুষ্ঠু ভাবে মনোনয়ন জমা দিক। সে দিকে লক্ষ্য রাখা আমাদের কর্তব্য।’’ যা দেখে বিজেপি এবং সিপিএম নেতৃত্ব বলছেন, এই সৌজন্যের রাজনীতিও তো অভিপ্রেত। দিকে দিকে এই ছবি ধরা পড়ুক।
মনোনয়ন দিতে অসুবিধা?
বারাবনির মতো দৃশ্য দেখা গিয়েছে পূর্ব বর্ধমানের ভাতারে । শাসক ও বিরোধী নেতার সৌজন্যের ছবি দেখা গিয়েছে ভাতারের বিডিও অফিসে। সোমবার ভাতার বিডিও অফিসে ভাতার গ্রাম পঞ্চায়েতের ৮ নম্বর বুথের সিপিএম প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা করেন নজরুল হক। মনোনয়নপত্র দাখিল করে বেরিয়ে আসার সময় তাঁর মুখোমুখি হন ভাতারের তৃণমূল বিধায়ক মানগোবিন্দ অধিকারী। তৃণমূল বিধায়ক হাসিমুখে সিপিএম নেতার কাছে জানতে চান, মনোনয়ন জমা দেওয়া হয়েছে কি না। বলেন, ‘‘মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়ে কোনও সমস্যা হয়নি তো?’’ সিপিএম নেতা জবাবে বলেন, ‘‘না, দাদা কোনও অসুবিধা হয়নি।’’ পরে তৃণমূল বিধায়ক বলেন, ‘‘নজরুল আমার পূর্ব পরিচিত। রাজনৈতিক মতাদর্শ আলাদা হলেও সৌজন্য থাকবেই।’’
যে ছবি পরিচিত
মনোনয়ন জমা দেওয়াকে কেন্দ্র করে ধুন্ধুমার পরিস্থিতি দেখা গিয়েছে উত্তর ২৪ পরগনার মিনাখাঁয়। সিপিএমের অভিযোগ, মনোনন জমা দিতে গেলে ব্লক অফিসে তাদের নেতা-কর্মী এবং সমর্থকদের আটকে দেন তৃণমূলের লোকজন। পরে সিপিএম পার্টি অফিস ঘেরাও করা হয় বলেও অভিযোগ। সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য সায়নদীপ মিত্রের অভিযোগ, মিনাখাঁ ব্লকের বামনপুকুরে সিপিএমের পার্টি অফিস ঘেরাও করে তাঁদের কর্মীদের আটকে রাখে তৃণমূল। শাসকদলের লোকজনের হাতে লাঠি, আগ্নেয়াস্ত্র ছিল বলেও অভিযোগ। যদিও সিপিএমের সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছে তৃণমূল। জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব বলছেন, বিরোধীরা কেউ মনোনয়ন জমা দিতে গিয়ে বাধা পেলে তাঁরা সাহায্য করবেন। সিপিএমের টিকিটে সোমবার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার কথা স্ত্রীর। তার আগের দিন রবিবার রাতে স্বামীর উপর রড, কাচের বোতল দিয়ে হামলার অভিযোগ উঠল শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলতলির সোনাটিকারি গ্রামের ঘটনা। হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেছে তৃণমূল। তাদের দাবি, পারিবারিক গন্ডগোলের জেরে হামলা হয়েছে। এই ঘটনায় তদন্তের আশ্বাস দেন বারুইপুরের এসডিপিও অতীশ বিশ্বাস। ভোটের অনেক আগে থেকেই উত্তপ্ত ভাঙড়। নিত্যদিন মেলে তৃণমূল এবং আইএসএফের সংঘর্ষের ঘটনা। এ হেন ভাঙড়ে পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন পর্বের বাকি দিনগুলি শান্তিপূর্ণ রাখতে মনোনয়ন কেন্দ্রের এক কিলোমিটারের মধ্যে ১৪৪ ধারা প্রয়োগ করার নির্দেশ দেয় রাজ্য নির্বাচন কমিশন। কিন্তু তার পরেও অশান্তির ঘটনা ঘটেছে।
‘বাধা’ এবং ‘প্রতিরোধ’
পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন পর্বে অশান্তির ঘটনায় শুরু থেকেই শিরোনামে মুর্শিদাবাদ। গত শনিবার শাসক-বিরোধী সংঘাতে ধুন্ধুমার হয়েছিল ডোমকল। সোমবারেও তার ব্যতিক্রম হল না। মনোনয়ন জমা দেওয়াকে কেন্দ্র করে সেখানে আবার সংঘর্ষে জড়ায় কংগ্রেস এবং তৃণমূল। তবে এ বার উলটপুরাণ! মিছিল করে মনোনয়ন জমা দিতে আসা শাসকদলের নেতার উপর হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাকদ্বীপেও একই ছবি দেখা গিয়েছে। সেখানেও তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের লাঠিসোঁটা নিয়ে তাড়া করার অভিযোগ উঠেছে সিপিএমের বিরুদ্ধে। পূর্ব বর্ধমানের বড়শুলেও সংঘর্ষে জড়িয়েছে তৃণমূল এবং সিপিএম। বিরোধীরা বলছেন, বাধা এলে প্রতিরোধ তো হবেই। যেমন, সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলছেন, ২০১৮ এবং ২০২৩ সাল এক নয়। অন্য দিকে শাসকদলের অভিযোগ, অশান্তির পরিবেশ তৈরি করছে শাসকদলই। ডোমকলে যে ছবি তৃণমূল জমানায় ফিকে হয়ে গিয়েছিল, শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, এ বারের পঞ্চায়েত ভোটে সেটাই ফিরিয়ে আনতে চাইছে সিপিএম-কংগ্রেস। তৃণমূল প্রতিনিয়ত হুমকি দিচ্ছে দলীয় নেতা-কর্মীদের। সন্ত্রাস করছে। এই পরিস্থিতিতে ‘মানুষের প্রয়োজনে’ ‘গুন্ডাগিরির’ নিদান দিলেন আসানসোল দক্ষিণের বিজেপি বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল। রানিগঞ্জে অগ্নিমিত্রার এই মন্তব্য জানাজানি হতেই সরব হয়েছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। যদিও, তাতে আমল দেয়নি বিজেপি। রবিবার রানিগঞ্জের অমৃতনগরে দলীয় কার্যালয়ে কর্মী-বৈঠক করেন অগ্নিমিত্রা। পরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে সর্বদল বৈঠক না করে আচমকা ভোট ঘোষণা করার জন্য রাজ্য নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে সরব হন তিনি। পরক্ষণেই তিনি তৃণমূলের বিরুদ্ধে সরব হন। বলেন, “আমি আমাদের দলের প্রার্থী, নেতা, কর্মীদের বাড়ি যাচ্ছি। তাঁদের বাড়ি থেকে আমি বেরোনোর পরেই শাসকদলের নেতারা তাঁদের ফোনে হুমকি দিচ্ছেন। আমরা তৃণমূলের মতো গুন্ডাগিরি করতে অভ্যস্ত নই। এ বার যদি দরকার পড়ে, মানুষের জন্য আমাদের সেটাও করতে হবে।”
শান্তিপূর্ণ হবে কি
সব মিলিয়ে পঞ্চায়েত ভোটে পরিচিত হিংসার ছবি দেখা গিয়েছে মনোনয়নের তৃতীয় দিনে। উত্তরবঙ্গের চোপড়া থেকে দক্ষিণবঙ্গের ভাঙড়, এই ছবির মাঝেও আশার কথা বলছে শাসকদল। যেমন মিনাখাঁয় সিপিএমের অভিযোগের পর জেলা পরিষদের পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ তথা অশোকনগরের তৃণমূল বিধায়ক নারায়ণ গোস্বামীর বার্তা, ‘‘যদি কেউ মনোনয়ন জমা দিতে গিয়ে বাধাপ্রাপ্ত হন, তা হলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করুন। আমি দায়িত্ব নিয়ে মনোনয়ন জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেব।’’ বজবজে ভোটের আগেই জেতার আনন্দে শাসকদলের বিজয় উৎসবের সঙ্গে আসানসোলের গোলাপ-রাজনীতি, দুই ছবিই দেখা গিয়েছে বাংলায়। এখন অভিষেক ঘোষণা মতো পঞ্চায়েত ভোট অবাধ এবং শান্তিপূর্ণ হয় কি না, তা সময়ই বলবে।