ঘটনাস্থলে পড়ে কুরবান শেখের দেহ। সোমবার। —নিজস্ব চিত্র।
অ্যাম্বুল্যান্স থেকে নেমে গুলি করে এক সঙ্গে তিন জনকে খুন। তা-ও দিন-দুপুরে! এবং ঘটনাস্থল সেই বীরভূম, যেখানে গত কয়েক বছরে শাসক তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে একের পর এক খুন হয়েছে। নিহতেরা হলেন কুরবান শেখ (২৮), মতুর্জা শেখ (২৫) ও বুড়ো শেখ (২২)। প্রথম জনের বাড়ি নানুর থানার পাপুড়ি গ্রামে। মর্তুজা ও বুড়ো যথাক্রমে বোলপুরের মুলুক ও সুলতানপুরের বাসিন্দা ছিলেন। জেলার রাজনীতিতে এঁরা তিন জনই গদাধর হাজরার লোক এবং কাজল-বিরোধী হিসেবে পরিচিত। নিহতেরা দলের কেউ নন বলে অনুব্রত দাবি করলেও নানুরের বিধায়ক কিন্তু জানিয়েছেন, ওঁরা তৃণমূলেরই কর্মী! নিহত কুরবান শেখের ভাইয়ের লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ ৪ জনকে মঙ্গলবার গ্রেফতার করেছে।
এ দিন বেলা ৩টে নাগাদ বোলপুর-পালিতপুর সড়কের উপরে তিন তৃণমূল কর্মী খুনের ঘটনার পরে তাই প্রশ্নের মুখে বীরভূমের তৃণমূল নেতৃত্ব। কিছু দিন আগেই মুখ্যমন্ত্রী তথা দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে পুরমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিমের মধ্যস্থতায় সন্ধি হয়েছিল দু’তরফের। এক দিকে নানুরের তৃণমূল নেতা কাজল শেখ এবং বীরভূমের তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের (কেষ্ট) অনুগামীরা। কিন্তু, সন্ধি যে নামেই, তার প্রমাণ বেশ কিছু দিন ধরেই মিলছিল বীরভূমে। দু’পক্ষের অনুগামীদের মধ্যে সংঘর্ষে বারবার তপ্ত হচ্ছিল নানুর ও বোলপুরের কিছু এলাকা। সেটাই চরম আকার নিল সোমবার। প্রাণ গেল অনুব্রত-ঘনিষ্ঠ নানুরের বিধায়ক গদাধর হাজরার অনুগামী তিন তৃণমূল কর্মীর। আর যে ঘটনার জন্য কাজল শেখের দিকে আঙুল তুললেন নিহতদের পরিবারের লোকজনেরা। যদিও ঘটনা হল, তিন-তিন জন খুন হওয়ার দিনে যুযুধান দুই নেতা কাজল ও গদাধর বিধানসভায় বৈঠক করছিলেন মধ্যস্থতাকারী সেই ববি হাকিমের সঙ্গেই!
ঠিক কী ভাবে খুন হয়েছেন কুরবানরা? সরাসরি মুখ না খুললেও খুনের কায়দা দেখে পুলিশের ধারণা, রীতিমতো ছক কষে এবং তাঁদের গতিবিধির উপরে নজরদারি চালিয়েই ওই তিন জনকে এ দিন মারা হয়েছে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে খবর, এ দিন নিহতেরা একটি স্কুটিতে চড়ে বোলপুর-পালিতপুর সড়ক ধরে বোলপুর শহর থেকে কিছুটা দূরে বাহিরী এলাকার দিকে যাচ্ছিলেন। তখনই বোলপুরের দিকে রওনা দেয় গদাধরবাবুর বিধায়ক তহবিলের টাকায় চারকলগ্রাম গ্রাম পঞ্চায়েতকে (এই পঞ্চায়েতেরই অধীন পাপুড়ি গ্রামে বাড়ি কুরবান ও কাজল শেখের) দেওয়া একটি অ্যাম্বুল্যান্স। অভিযোগ, ওই অ্যাম্বুল্যান্সেই সওয়ার ছিল কাজল-শিবিরের কিছু লোক।
পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, বাহিরী নিমতলা বাসস্টপের কিছুটা আগে একটি নির্জন এলাকায় অ্যাম্বুল্যান্সটি সোজা গিয়ে ধাক্কা মারে স্কুটিতে। অ্যাম্বুল্যান্সের তলায় ঢু়কে যায় স্কুটির অনেকটা অংশ। কুরবান-সহ তিন আরোহী রাস্তায় ছিটকে পড়লে অ্যাম্বুল্যান্স থেকে আততায়ীরা নেমে তাঁদের গুলি করে। একটি সূত্রের দাবি, ঘটনাস্থলেই মারা যান তিন জন। জেলা পুলিশের কর্তারা অবশ্য গোটা ঘটনা নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন।
তৃণমূলের এক সূত্রে জানা যাচ্ছে, ওই স্কুটির মালিক মতুর্জা। কয়েক দিন ধরেই মতুর্জা বোলপুরে তৃণমূলের পার্টি অফিস থেকে ফেরার সময় কুরবানকে স্থানীয় সিঙ্গি গ্রামে (কাজলের দাপটে কুরবান দীর্ঘদিন ঘরছাড়া বলে পরিবারের দাবি) নামিয়ে দিতেন। পরে সুলতানপুরে বুড়োকে নামিয়ে নিজে বাড়ি ফিরতেন। এ দিনও সে ভাবেই ফিরছিলেন তিন জন। জেলা পুলিশের একটি সূত্রের বক্তব্য, তিন জনের এই রোজকার ফেরার সময় জেনে নিয়েই হামলার ছক কষা হয়েছিল। ঘটনার সময় কাছাকাছি ছিলেন দাবি করে এক ব্যক্তি এ দিন জানান, স্কুটির আরোহীরা মাটিতে পড়ে গেলে প্রথমে অ্যাম্বুল্যান্স থেকে নেমে আততায়ীরা কুরবানকে লক্ষ করে গুলি করে। তা দেখে মতুর্জা ও বুড়ো মাটিতে পড়ে থাকা অবস্থাতেই পাল্টা গুলি চালায়। কিন্তু সেই গুলি অ্যাম্বুল্যান্সের কাচে লাগে। এর পরেই আততায়ীরা তিন জনকে গুলি করে পালায়।
সোমবার রাত পর্যন্ত পুলিশের কাছে নিহতদের পরিবারের তরফে কোনও লিখিত অভিযোগ করা হয়নি। কিন্তু এর পিছনে কাজলের লোকজনই রয়েছে বলে দাবি করেছেন কুরবানের ভাই মন শেখ। এ দিন বোলপুর হাসপাতাল চত্বরে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘‘যে হেতু আমার দাদা গদাধর হাজরার অনুগামী, তাই আমাদের গ্রাম ছাড়া করেছিল কাজল শেখের লোকেরা। কিন্তু সম্প্রতি ঠিক হয়, আমরা গ্রামে ফিরব। তার জেরেই হয়তো হয়তো দাদাকে খুন করা হয়েছে।’’ হাসপাতালে কান্নায় ভেঙে পড়ে মতুর্জার বাবা আমজাদ শেখ বলেন, ‘‘আমার ছেলে কেষ্টর দল করে বলেই জানি। তৃণমূলেরই লোকেরা মেরেছে।’’
জেলা তৃণমূলের একটি সূত্রের খবর, এ দিনের হামলার পিছনে বদলার রাজনীতি থাকতে পারে। ঠিক এক সপ্তাহ আগে, গত সোমবার দুপুরে বোলপুরে কাজল শেখের গাড়ি লক্ষ করে বোমাবাজি ও গুলি চালানোর হামলায় হত তিন অভিযোগ ওঠে। ওই ঘটনায় গদাধর-শিবিরের হাত দেখেছিলেন কাজল-অনুগামীরা। এমনকী, হামলাকারীদের তিনি শনাক্ত করতে পেরেছেন বলেও দাবি করেন বর্ধমানের কেতুগ্রামের তৃণমূল বিধায়ক শেখ শাহনওয়াজের ভাই কাজল।
ওই ঘটনার পরে নানুর বাসিন্দা যে ৮ জনের বিরুদ্ধে বোলপুর থানায় লিখিত অভিযোগ করেছিলেন কাজল শেখ, তাঁদের অন্যতম হলেন এ দিনের হামলায় নিহত কুরবান শেখ!
এত কিছুর পরেও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কথা এক কথায় উড়িয়ে দিয়েছেন দলের জেলা সভাপতি অনুব্রত। তাঁর দাবি, ‘‘এর সঙ্গে গোষ্ঠী কোন্দলের কোনও সম্পর্ক নেই। নিহতেরা কেউ আমাদের দলের নয়। আমি ব্লক সভাপতিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। এটা দুষ্কৃতীদের নিজেদের ঝামেলা।’’
অনুব্রত এ কথা বললেও তাঁরই ঘনিষ্ঠ নানুরের বিধায়কের গলায় কিন্তু অন্য সুর। কলকাতা থেকে ফেরার সময় ফোনে গদাধর হাজরা বলেন, ‘‘যাঁরা খুন হয়েছেন, তাঁরা আমাদেরই লোক। পঞ্চায়েতের অ্যাম্বুল্যান্সে চেপে কেউ বা কারা ওই তিন জনকে মেরেছে বলে শুনেছি। তাই আততায়ীরাও আমাদের দলেরই কেউ হবে।’’ গদাধর-ঘনিষ্ঠ নানুরের এক তৃণমূল নেতার কথায়, ‘‘আমাদের উপরের স্তরে বিবাদ মিটলেও নিচু স্তরে যে কোন্দল রয়ে গিয়েছে, এ দিনের ঘটনাই তার প্রমাণ।’’
গদাধরবাবু আবার দাবি করেছেন, অ্যাম্বুল্যান্সটি পঞ্চায়েতকে দেওয়া হলেও তার দেখভাল করেন কাজলই। তাই কাজলই বলতে পারবেন, কারা ওই অ্যাম্বুল্যান্স আজ ব্যবহার করেছিল। যা শুনে কাজল শেখের দাবি, ‘‘ঠিক কী ঘটেছে, আমি জানি না। আমি তো গদাধরের সঙ্গেই বিধানসভায় ফিরহাদ হাকিমের সঙ্গে বৈঠক করছিলাম! তবে শুনলাম, ওই পঞ্চায়েতের অ্যাম্বুল্যান্সে চড়ে নাকি খুনের ঘটনা ঘটেছে।’’ তাঁর পাল্টা দাবি, ‘‘ওই অ্যাম্বুল্যান্সটি চারকলগ্রাম পঞ্চায়েত দেখভাল করে। গাড়ির চালক পাপুড়ি গ্রামের মাখন শেখই ভাড়া চুক্তি করে। মাখন পলাতক বলে শুনেছি।’’ চারকলগ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান মমতাজ বেগম বলেন, ‘‘বছর খানেক আগে বিধায়ক তহবিল থেকে ওই অ্যাম্বুল্যান্সটি পাওয়া যায়। পঞ্চায়েতই সেটির দেখভাল করে। কিন্তু এ দিন কে নিয়ে গিয়েছিল, বলতে পারব না। কারণ, আমি বাপের বাড়িতে রয়েছি।’’
ঘটনা হল, নানুরের রাজনীতিতে এক সময় কাজল শেখ ও গদাধর হাজরা পরস্পরের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। গোটা বীরভূমে যাঁর একচ্ছত্র দাপট, সেই অনুব্রত মণ্ডলও তখন কাজল শেখের দাপটে নানুরে ঢুকতে পারতেন না। রাজ্যে পালাবদলের পর থেকে গোটা জেলায় নানুর এক বিচ্ছিন্ন ভূমি হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে এসেছে তৃণমূল শিবিরে। পরে অবশ্য সমীকরণ বদলায়। গদাধর নাম লেখান অনুব্রত-শিবিরে। এক দিকে কাজল, অন্য দিকে গদাধর হাজরা ও নানুরের ব্লক তৃণমূল সভাপতি সুব্রত ভট্টাচার্য— বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। নানুরের অধিকাংশ পঞ্চায়েত সমিতি এবং বোলপুরের কয়েকটি পঞ্চায়েতেও গদাধর-অনুগামীদের কোণঠাসা করে ফেলে কাজলের লোকেরা। পঞ্চায়েতে ১০০ দিনের কাজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প কিংবা বালির ঘাটের দখলকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের গোলাগুলিতে বহুবার অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে নানুর ও লাগোয়া বোলপুরের কিছু এলাকা। দু’পক্ষের বিরুদ্ধেই দলীয় কার্যালয়ে ভাঙচুর আর দখলের অভিযোগ উঠেছে। কয়েক মাস আগেই নানুরে সভা করে অনুব্রতকে পাশে নিয়ে কাজল শেখকে ‘ক্রিমিনাল’ বলে তোপ দেগেছিলেন ববি হাকিম। বলেছিলেন, দলে ‘ক্রিমিনালদের’ জায়গা নেই।
নানুরে কাজলের দাপট ও প্রভাব কিন্তু তার পরেও এতটুকু কমেনি। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে বুঝে তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে পুরমন্ত্রী ববি হাকিমেরই দৌত্যে অনুব্রত ও কাজলের সন্ধি হয়। তার পর থেকে বিভিন্ন দলীয় কর্মসূচিতে অনুব্রত, কাজল ও গদাধরকে এক সঙ্গে দেখা গিয়েছে। পুরমন্ত্রী এ দিন বলেছেন, ‘‘গদাধর ও কাজলকে বলেছি, জেলা সভাপতির সঙ্গে আলোচনা করে দলের কাজ করতে হবে। কাজল আমার কাছে অভিযোগ করেছে, ক’দিন আগে ওর বাড়িতে দুষ্কৃতীরা বোমা মেরেছে। আমি এসপি-কে ফোন করে বলেছি, যাদের হাতে বোমা আছে, আগ্নেয়াস্ত্র আছে, সেই সব দুষ্কৃতীদের ধরতে হবে।’’ কাজল নিজেও বলছেন, ‘‘খুনের রাজনীতি যারা করে, তাদের সঙ্গে আমি নেই। গোষ্ঠী কোন্দল বলে কিছু বীরভূমে নেই। গদাধরের সঙ্গে আমার কোনও বিরোধও নেই। আমরা এক সঙ্গে চা খাই, ডিনারও করি!’’
তলায় তলায় অবশ্য দ্বন্দ্ব কখনও মেটেনি। দু’পক্ষের সংঘর্ষও থামার লক্ষণ নেই। বন্ধ হচ্ছে না রক্তপাতও। ক’দিন আগেই বোলপুরের আলবাঁধা পঞ্চায়েত এলাকার তৃণমূল নেতা মহাদেব মণ্ডল খুন হয়েছেন। সে ক্ষেত্রেও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের দিকেই আঙুল উঠেছিল। কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়া বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে! কারও কোনও নিরাপত্তা নেই। অথচ মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রীর কোনও হেলদোল নেই!’’ বিজেপি-র বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যেরও বক্তব্য, ‘‘রাজ্যে এখন আইনের শাসন বলে কিছু নেই। পুলিশ-প্রশাসনের উপরেও কোনও আস্থা রাখার জায়গা নেই। তৃণমূলের গোষ্ঠী-সংঘর্ষে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন।’’ সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রামচন্দ্র ডোমের মন্তব্য, ‘‘গোটা বীরভূমই এখন শাসকদলের দ্বন্দ্বে দীর্ণ।’’
বিরোধীরাই শুধু নন, সোমবারের তিন খুনের ঘটনা থেকে গদাধর ও কাজলের দ্বন্দ্ব আরও একবার স্পষ্ট হল বলে মনে করছেন জেলা তৃণমূলের একাংশ। নানুর ব্লকের এক তৃণমূল নেতা এ দিন বলছিলেন, ‘‘গদাইয়ের সঙ্গে কাজলের সম্পর্ক এখন ‘কুশল বিনিময়ের’! কাজল এখন প্রকাশ্যেই বলে বেড়ায়, অনুব্রতর সঙ্গে তার প্রতিদিনের ওঠাবসা। সেটা গদাই হজম করবে কী করে! ফলে, উপরতলা যতই সন্ধি চাপানোর চেষ্টা করুক না কেন, এ ফাটল কখনও বোজার নয়!’’