ফুলবাড়ি সীমান্ত পেরোতে হাজারো ভোগান্তি চলছেই

বাংলাদেশের নীলফামারির ডোমরা’র বাসিন্দা, পেশায় চাষি ভালুরাম বর্মন। বুক, পেটের রোগে অসুস্থতা অনেকদিন ধরেই। শিলিগুড়ির সেবক রোডের পানিট্যাঙ্কি এলাকায় থাকেন তাঁর এক নিকট আত্মীয়। সেখানেই আসছিলেন।

Advertisement

কৌশিক চৌধুরী

ফুলবাড়ি শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০১৬ ০২:৫৭
Share:

দফায় দফায় চলছে তল্লাশি। একবার ব্যাগ খুলে দেখা হচ্ছে।

বাংলাদেশের নীলফামারির ডোমরা’র বাসিন্দা, পেশায় চাষি ভালুরাম বর্মন। বুক, পেটের রোগে অসুস্থতা অনেকদিন ধরেই। শিলিগুড়ির সেবক রোডের পানিট্যাঙ্কি এলাকায় থাকেন তাঁর এক নিকট আত্মীয়। সেখানেই আসছিলেন। বৃহস্পতিবার চড়া রোদে হাতে ছোট ব্যাগ নিয়ে কাঁটাতারের বেড়ার পাশে সীমান্ত গেটে এসে হাঁফাচ্ছিলেন ভালুরামবাবু। তা দেখে এগিয়ে গেলেন শুল্ক দফতরের এক কর্মী। হাতে থাকা পাসপোর্ট পরীক্ষার পরে তাঁকে নিয়ে ফুলবাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলেন ওই সরকারি কর্মী। প্রায় ৫০০ মিটার হাঁটার পরে অভিবাসন দফতরে পৌঁছলেন দু’জনে। তার পরেই শুরু হল আরেক গল্প।

Advertisement

কখনও চত্বরের শেডে বসিয়ে কাগজ পরীক্ষা করে নিয়ে যাওয়া হল দোতলায়। সেখানে ব্যাগপত্র খুলে দেখার পরে আবার নিয়ে আসা হল নীচের তলায়। সেখানে পুলিশের পক্ষ থেকে পাসপোর্ট, ভিসা পরীক্ষা করার পরে আরেক দফায় ব্যাগে তল্লাশি। পাশে থাকায় আস্ত স্ক্যানার থাকলেও কাজ করছে না বলে ব্যবহারই করা হল না। সব দেখে বুঝে ঘাবড়ে যাচ্ছিলেন ভালুরাম। বললেন, ‘‘দুই সীমান্ত মিলিয়ে তো প্রায় দেড় কিলোমিটার হেঁটেই ফেললাম। একতলা, দোতলা উঠলাম। এখন আবার না কি প্রায় ১ কিলোমিটার হেঁটে ফুলবাড়ি মোড়ে গিয়ে গাড়ি ধরতে হবে। আগে জানলে তো বুড়িমারি দিয়েই আসতাম। এত ভোগান্তি হত না।’’

ভোগান্তির একই গল্প শুনিয়ে গেলেন রংপুরের ব্যবসায়ী শাহনওয়াজ হোসেনের পরিবারও। স্ত্রী, ছেলে, শ্বশুরমশাইকে নিয়ে এ মাসেই ঘুরতে এসেছিলেন দার্জিলিঙে। তিনি বললেন, ‘‘বুড়িমারি এবং বিমানে গেলেই মনে হচ্ছে সুবিধা হত। কম সময়ের নতুন সীমান্ত পথ ভেবে এসেছিলাম। কিন্তু কষ্ট ছাড়া কিছুই নেই।’’ মালপত্র নিয়ে মহিলাদের দু’পাশে এতটা করে হাঁটা। দুটি স্ক্যানার মেশিন থাকলেও তার বদলে হাত দিয়ে সমস্ত মালপত্র খুলে পরীক্ষা। হয়রানি হল। পরিকাঠামো একেবারেই ভাল হয়নি। একই কথা জানিয়েছেন বাংলাবান্ধার বাসিন্দা মহম্মদ আশরাফুল ইসলাম। তাঁর কথায়, ‘‘এত হেঁটে যাতায়াত করতে করতে অসুস্থ হওয়ার জোগাড়। কুলি, গাড়ি কিছু নেই। দুই দেশের অফিসারদের বিষয়টি দেখা দরকার।’’

Advertisement

শিলিগুড়ি লাগোয়া ভারত-বাংলাদেশের ফুলবাড়ি সীমান্ত পথ দিয়ে বাণিজ্যের পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে ‘ইমিগ্রেশন’ শুরু হয়েছে গত ফেব্রুয়ারিতে। পরিকল্পনায় অনেক কিছু থাকলেও পরিকাঠামো এখনও ঠিকঠাক তৈরি না হওয়ায় সমস্যায় পড়তে হচ্ছে দুই দেশের নাগরিকদেরই। সুরক্ষার দিক থেকেই লোকজনদের হাঁটিয়ে এক দু’জন কর্মী দিয়ে হাঁটিয়ে দফতর অবধি আনার ক্ষেত্রে সুরক্ষার ঝুঁকিও থাকছে বলে মানছেন পুলিশ, শুল্ক দফতরের অফিসারেরা। তেমনিই, বাণিজ্য, অভিবাসনের আসা-যাওয়ার একটিই ছোট গেট থাকায় আরও সমস্যায় পড়ছেন ট্রাক চালকেরা। সীমান্ত পথ এবং গজলডোবা যাওয়ার রাস্তা জুড়ে দিনরাত দাঁড়িয়ে থাকছে শ’য়ে শ’য়ে ট্রাক। মহম্মদ বসির, সীতারাম কেরকেট্টার মতো চালকেরা বলেন, ‘‘খালি বাসিন্দারা নন, আমাদের হ্যাপাও কম নয়। রোজ ওপারে ২০০টির বেশি ট্রাক যাচ্ছে না। একটা ট্রাকের তাই ২-৩ দিন লেগেই যাচ্ছে।’’

অভিবাসনের কর্মীরা জানাচ্ছেন, একে দফতর থেকে গেটের দূরত্ব অনেকটাই। তার উপরে গাড়ি ও হাঁটা পথের জন্য আলাদা রাস্তা এখনও তৈরি হয়নি। ট্রাকের পরীক্ষা, ওজন, কাগজপত্র সব দফতরের ভিতরে গাড়ি নিয়ে ঢুকে করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে গেটের কাছে মাঝেমধ্যেই যানজট হয়। বসার শেড হলেও রেস্টরুম তৈরি হয়নি। তবে সবচেয়ে সমস্যায় দুইপারের নাগরিকেরা। বাসিন্দাদের সমস্যার কথা মানছেন প্রশাসনিক আধিকারিকেরাও। যেমন বিএসএফের নর্থবেঙ্গল ফ্রন্টিয়ারের ডিআইজি ডি হাওকিপ বলছেন, ‘‘সীমান্ত গেটের পাশেই নথিপত্র, জিনিসপত্র পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলে ভাল। তবে জমির সমস্যার জন্য তা হয়নি। তার পরে সেখানে থেকে লোকালয়ে যাওয়ার বিষয়টিও রয়েছে। দেখি, শুল্ক, পুলিশ এবং ল্যান্ডপোর্ট অথরিটির আগামী বৈঠক বিষয়গুলি আলোচনা হবে।’’

শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মা বলেন, ‘‘বাসিন্দাদের যাতায়াতের কিছু সমস্যা আছে। স্ক্যানার আমাদের হেফাজতে থাকলেও তা শুল্ক দফতরকে দেওয়া হয়েছে।। নাগরিক, ব্যবসায়ী সকলের সুবিধার কথা মাথায় রেখেই ধীরে ধীরে পরিকাঠামো গড়ে উঠছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সমস্ত এজেন্সি তা দেখছে।’’

১৯৯৯ সালে ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালের চুক্তির মাধ্যমে সীমান্ত বাণিজ্য পথটি খোলে। ভারতের জন্য বাণিজ্যপথটি খোলা হয় ২০১৩ সালে। ধীরে ধীরে শিলিগুড়ি লাগোয়া বাণিজ্য পথটির গুরত্ব বাড়তে থাকে। চলতি বছরের শুরুতে চালু হয়েছে অভিবাসন। তবে বর্তমানে গড়ে দুই পাড় মিলিয়ে ৪৫-৫০ জনের বেশি যাতায়াত করছেন না। বেশি আসছেন বাংলাদেশ থেকেই। চিকিৎসা, পড়াশোনা এবং পর্যটক হিসাবে। ভারত থেকে পাথর ছাড়াও চাল, গম, ভুট্টা ছাড়াও মাঝেমাঝে যায় আদা ও সোয়াবিনের গুঁড়ো। কিন্তু বিভিন্ন পরীক্ষাগার তৈরি না হওয়ায় দেড় বছর ধরে ভারতে আমদানি ব্যবসা নেই। নেপালের ক্ষেত্রে ব্যাটারি, ফুড প্রোডাক্টস, আলু, তুলা, পাটের মতো নানা জিনিসের আমদানি রফতানি চলছে।

শুল্ক দফতরের শিলিগুড়ি ডিভিশনের সহকারি কমিশনার ইউকে ধ্রূব বলেন, ‘‘প্রথমত ব্যাগেজ স্ক্যানিং এর সমস্যা হচ্ছে। নাগরিকদের একতলা-দোতলায় ঘোরাঘুরি করতে হচ্ছে। তার পরে অভিবাসনের আলাদা প্যাসেজ নেই। ট্রেড রুটেই যাতায়াত চলছে। সীমান্ত গেট থেকে গাড়ির ব্যবস্থাও নেই। আমাদের কর্মীদের লোকজনকে হাঁটিয়ে দফতরে নিয়ে আসতে হচ্ছে। আশা করছি, ধীরে ধীরে সমস্যাগুলি মিটবে।’’

ছবি: সন্দীপ পাল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement