অধ্যাপক শেখ মকবুল ইসলাম
শুধু রথযাত্রায় নয়। জগন্নাথে মন তাঁর ৩৬৫ দিনই।
সর্বোচ্চ আদালতে রথের টানাপড়েনের উৎকণ্ঠাতেও সোমবার দিল্লির কলেজে ওয়েবিনারের প্রস্তুতিতে ডুবে শেখ মকবুল ইসলাম। জগন্নাথ-চেতনা নিয়েই বলবেন বাংলার অধ্যাপক। রমজানে মাসভর রোজা রেখে জগন্নাথ-তত্ত্ব নিয়ে তাঁর নতুন বইয়ের লেখালেখিও সদ্য শেষ করেছেন। লকডাউনে জনহীন সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল মিশন কলেজে শ্রী জগন্নাথ রিসার্চ সেন্টারের দোতলার ঘরে পুরী, ভুবনেশ্বরে জগন্নাথ পরিমণ্ডলের সঙ্গে কথা হচ্ছে বার বার।
১৫৫ বছরের খ্রিস্টান কলেজের প্রাঙ্গণেই প্রথম জগন্নাথ-দর্শন মকবুলের শৈশবে। বাবা শেখ সাজাদ আলি, কলেজের অফিস-কর্মী। রসায়নের ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট দোলগোবিন্দ মোহান্তি জেঠুদের বাড়িতে জগন্নাথদেবকে প্রথম দেখে বিস্ফারিত শিশু! বাবা বোঝালেন, ইনি ওড়িশার দেবতা, জগন্নাথ মানে বিষ্ণু। চার দশক বাদে সেই কলেজের অধ্যাপক মকবুলসাহেব বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) প্রকল্পে দুই বাংলা ও নেপালের জগন্নাথ-সন্ধানে শামিল। ২০১০ সাল। ঘর ও পরিকাঠামোর জোগানে জগন্নাথ-চর্চা কেন্দ্র গড়ে তখনই পাশে দাঁড়ান সেন্ট পলস কলেজ কর্তৃপক্ষ।
আরও পড়ুন: মত বদলে রথে সায়, পুরীতে কার্ফু
“বৌদ্ধিক-চর্চার আবার হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান কী? জগন্নাথ-তত্ত্ব, বাংলা-ওড়িশার সংস্কৃতি নিয়ে মকবুল সাহেবের অনেক দিনের কাজ। ওঁকে তো সাহায্য করতেই হয়।”--- বলছিলেন কলেজের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দেবাশিস মণ্ডল। ধর্মে খ্রিস্টান দেবাশিসবাবু হাসেন, “কলেজের চ্যাপেলের ধর্মীয় সভাতেও তো বাইবেলের কথা আলোচনা হয়। ক্রুশবিদ্ধ জিশুর বাণী নিয়েও মকবুল সাহেব সুন্দর বললেন!” ক্যাম্পাস লাগোয়া লংসাহেবের গির্জায় (সেন্ট পলস হোলি ট্রিনিটি চার্চ) এসেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। মকবুল বলেন, “আগের টিচার ইনচার্জ জন ডেভিড প্রভাকরের কাছেও সমান উৎসাহ পেয়েছি।”
আরও পড়ুন: ‘জয় জগন্নাথ’ বলে জয়গান শাহ-মোদীরও
বাংলা-ওড়িশার প্রবাদ-প্রবচন নিয়ে কলকাতায় পিএইচডি, বাংলা-ওড়িশার জগন্নাথ-চর্চা নিয়ে উৎকল বিশ্ববিদ্যালয়ে ডি-লিট পান মকবুল। ইউজিসি-র কাজে বাংলা, বাংলাদেশ, নেপাল, আন্দামান, উত্তর-পূর্বে ঘুরে জগন্নাথ-সন্ধান। ২০১৫য় ওড়িশার মর্যাদামণ্ডিত নবকলেবর পুরস্কারও মকবুলই পেয়েছিলেন। জার্মান ভারততত্ত্ববিদ হারমান কুলকের পরে তিনিই বিরল স্বীকৃতির প্রাপক। গোটা দেশের মঠে-বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মানিত জগন্নাথ বিশারদ ৫২ বছরের মকবুল এখন কলেজের গবেষণা কেন্দ্রে পড়ুয়াদের আলো দেখাচ্ছেন।
নিজের ধর্ম ছাড়েননি। ধর্মীয় পরিচয়ের জন্য একদা কলকাতাতেও বাড়ি ভাড়া পেতে ঈষৎ ঠোক্কর খেয়েছিলেন মকবুল। তবে তিনি বলছেন, “বিভিন্ন মঠে, মন্দিরে জগন্নাথ-চর্চা করে সম্মান, ভালবাসাই বড় প্রাপ্তি। কয়েক জন সঙ্কীর্ণমনা সর্বত্র থাকেন।”
কলেজ ক্যাম্পাসেই উৎকলীয় কর্মচারীদের সান্নিধ্য জগন্নাথকে নিয়ে আগ্রহের হাট খুলে দেয়। আর ওড়িয়াও হয়ে ওঠে মকবুলের দ্বিতীয় মাতৃভাষা। গবেষণা-পর্বে শৈশবের এই নির্মাণ তাঁকে সাহায্য করেছে। মুসলিম বন্ধুরাও মকবুলের গৌরবে গর্বিত। নানা মঠে যাতায়াতের দরুন, আমিষবর্জিত জীবন। তাতে মজা করে কেউ কেউ ডাকেন, গোঁসাইজি!
“সব ধর্মের মানুষের সঙ্গে মিশেছি। ইচ্ছে মতো ধর্ম-সংস্কৃতির গহনে ডুব দিয়েছি। জন্মপরিচয় বাধা হয়নি। এটাই আমার বাংলা, ভারতবর্ষ।”--- রথযাত্রার প্রাক্কালে তাঁর জগন্নাথচর্চার অভিযাত্রা মেলে ধরলেন মকবুল।