2021 West Bengal Assembly Election

WB Political Scenario: ২ মে থেকে ২ মে: এগিয়েছেন ১ মেয়ে, পদ্মবনে কাঁটা, বাম শিবিরে মৃদু অক্সিজেন

ঘটনা পরম্পরার বিচারে এই একটা বছর অনেক কিছুর সাক্ষী। একের পর এক নির্বাচন, উপনির্বাচন, দলবদল, অঘটনে ভরা ৩৬৫ দিন।

Advertisement

পিনাকপাণি ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ মে ২০২২ ০৯:৩২
Share:

রাজনৈতিক অগ্রগতিতে আশেপাশে কেউ নেই‌। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

একটা বছর। ২০২১ সালের ২ মে থেকে ২০২২ সালের ২ মে। গঙ্গা দিয়ে যতটা জল গড়িয়েছে, প্রায় ততটাই বদল এসেছে বাংলার রাজনীতিতে। এক বছর আগের এই দিনেই গঙ্গাপাড়ের নীলবাড়ি দখলের লড়াইয়ের ফয়সালা হয়েছিল। ইতিহাস তৈরি করে তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় এসেছ্যিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল। বাংলা দেখিয়েছিল, সে নিজের মেয়েকেই চায়।

অন্যদিকে, দু’শো পার করার স্বপ্ন দেখা এবং দেখানোর শেষে মাঝ পথের আগেই মেদিনী গ্রাস করেছিল গেরুয়া রথচক্র।

তার পর থেকেই ক্ষয়ের পালা শুরু বিজেপিতে। পদ্মবন ভরেছে কাঁটায়। অন্য দিকে, তৃণমূলের বিজয়রথ এগিয়েই চলেছে। স্পষ্ট তৃতীয় শক্তি হয়ে উঠতে পারেনি কেউই। ভোট মিটতে না মিটতেই ভেঙেছে বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোট। একটা আসনে জিতলেও রাজ্য রাজনীতি থেকে হারিয়ে গিয়েছেন ‘ভাইজান’ আব্বাস সিদ্দিকি। শূন্যের গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খাচ্ছে কংগ্রেস। আর ডুবতে ডুবতেও মৃদু অক্সিজেনের দৌলতে ভেসে থাকার মরিয়া লড়াইয়ে সিপিএম।

রাজ্য রাজনীতির শেষ এক বছরের সারাংশ এটুকুই।

তবে ঘটনা পরম্পরার বিচারে এই একটা বছর অনেক কিছুর সাক্ষী। একের পর এক নির্বাচন, উপনির্বাচন, দলবদল, অঘটনে ভরা ৩৬৫ দিন। এ কথা বলাই যায় যে এই একটা বছরে বারো মাসে তেরো পার্বণের মতো এসেছে নির্বাচন আর আদালতের নির্দেশ। যা নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে একের পর এক তরঙ্গ খেলে গিয়েছে। যে ঢেউ এখনও প্রবহমান।

Advertisement

সরেছেন দিলীপ, এসেছেন সুকান্ত। ফাইল চিত্র।

এই একটা বছরে কংগ্রেসকে বাদ দিলে রাজ্যের বাকি তিন প্রধান রাজনৈতিক দলে সংগঠনেও এসেছে অনেক বদল। তৃণমূলের সংগঠনে গুরুত্ব বেড়েছে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ডায়মন্ডহারবারের সাংসদ হয়েছেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। সিপিএমেও নতুন রাজ্য সম্পাদক হয়ে এসেছেন মহম্মদ সেলিম। আর বিজেপিতে রাজ্য সভাপতি পদে দিলীপ ঘোষের জায়গায় এসেছেন সুকান্ত মজুমদার। সেই সঙ্গে রাজ্য থেকে জেলায় জেলায় বদলেছে দলের কমিটি। তা নিয়ে ক্ষোভ, বিক্ষোভে জর্জরিত গেরুয়া শিবির। বিদ্রোহ আর পদত্যাগের মিছিল চলছে।

ঠিক এক বছর আগে ভোট গণনার দিন ২ মে সকলেও গেরুয়া শিবিরের আশা ছিল তুঙ্গে। কিন্তু কিছুটা সময় এগোতেই স্পষ্ট হয়ে যায় মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে মমতাই ফিরছেন। তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় আসছে তৃণমূলই। আরও বেশি শক্তি নিয়ে। দিনের শেষে ফল ছিল তৃণমূল ২১৩ আর বিজেপি ৭৭। স্বপ্নভঙ্গ হওয়া গেরুয়া শিবিরের কাছে গর্ব করে বলার মতো ছিল একটাই কথা। নন্দীগ্রামে শুভেন্দু অধিকারীর জয়। টানটান লড়াই শেষে মমতাকে হারানো নিয়ে অবশ্য খুব বেশি উল্লাস দেখাতে পারেনি বিজেপি। কারণ, লক্ষ্যের অনেক অনেক দূরে থমকে যাওয়ার গ্লানিতে বিষাদের মাত্রাই ছিল বেশি।

Advertisement

বিষাদের সঙ্গে শুরু হয় বিচ্ছেদ-পর্ব। ভোটের আগে তৃণমূল থেকে বিজেপিতে আসা নেতারা তখন থেকেই দূরত্ব বাড়ানো শুরু করে দেন। একে একে ঘরে ফিরেছেন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে সব্যসাচী দত্তরা। ফিরেছেন আরও অনেকে।

মুকুলের দলবদল ছিল বিজেপির বড় ধাক্কা। ফাইল চিত্র।

মে মাসে ভোটের ফল প্রকাশের পর জুনেই কৃষ্ণনগর উত্তর থেকে জয়ী মুকুল রায়ের দলবদল। এর পরে আরও চার বিধায়ক গিয়েছেন তৃণমূলের শিবিরে। ওদিকে দুই সাংসদ জগন্নাথ সরকার ও নিশীথ প্রামাণিকের জেতা শান্তিপুর ও দিনহাটা বিজেপির হাতছাড়া হয়েছে উপনির্বাচনে। ভবানীপুরের উপনির্বাচনে এক অর্থে দাঁড়াতেই পারেনি পদ্ম-শিবির। ভাঙনও থামেনি। দু’বারের সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় দল ছেড়েছেন। তিনি এখন সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে খালি হওয়া বালিগঞ্জ আসনে তৃণমূলের বিধায়ক। আর ২০১৪ এবং ২০১৯ সালে জেতা বিজেপির আসানসোলও এখন তৃণমূলের। সব মিলিয়ে পদ্মের সাংসদ সংখ্যা কমে ১৭ আর বিধায়ক সংখ্যা কমে ৭০। উল্টো দিকে শাসক তৃণমূলের সাংসদ সংখ্যা বেড়ে ২৩ আর বিধায়ক সংখ্যা বেড়ে ২২১। তবে এই হিসাবের মধ্যে নেই কলকাতার মানিকতলা। প্রাক্তন মন্ত্রী সাধন পাণ্ডের মৃত্যুতে খালি রয়েছে কলকাতার ওই আসন। রাজ্যে উপনির্বাচনের ইতিহাস জারি থাকলে সেটিও শাসকেরই থাকবে।

বিজেপি শুধু উপনির্বাচনেই নয়, পর্যুদস্ত কলকাতা-সহ রাজ্যের সব পুরভোটেও। কলকাতায় জেতা ওয়ার্ড খুইয়ে দখলে মাত্র তিন। গত লোকসভা বা বিধানসভা নির্বাচনে জেতা এলাকাতেও পুরসভায় দাঁড়াতেই পারেনি গেরুয়া শিবির। খড়্গুপর থেকে শিলিগুড়ি সর্বত্র এক ফল।

ভবানীপুর উপনির্বাচনে পা রাখতে পারেনি বিজেপি। ফাইল চিত্র।

তৃণমূলের এই বিপুল তরঙ্গের মধ্যেও তাহেরপুর পুরসভা দখলে রাখতে পেরেছে বামেরা। কলকাতা পুরভোটেও বেড়েছে তাদের প্রাপ্ত ভোটের শতাংশ। আর সদ্য হওয়া বালিগঞ্জ বিধানসভা আসনে তো দ্বিতীয় স্থানে সিপিএম। তারা সেখানে ভোটও বাড়িয়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। এই ফল সার্বিক ভাবে বামেদের সুদিন ফেরার ইঙ্গিত বলে দাবি করা না গেলেও এটা ঠিক যে, বিধানসভায় ব্রাত্য বামেরা একটু হলেও দম নেওয়ার জায়গায়।

এক বছরে তৃণমূলের এগনোর মাপকাঠি ভোটবৃ্দ্ধি ধরা হলে তার সবচেয়ে বড় নজির হালে জেতা আসানসোলের ফল। যে আসনে কোনও দিনই খাতা খুলতে পারেনি ঘাসফুল, সেখানে তিন লাখের বেশি ভোটে জয় উল্লসিত করেছে তৃণমূলকে। তবে এই এক বছরে উল্লাসের সঙ্গে অস্বস্তিও ফিরে ফিরে এসেছে শাসক শিবিরে। একের পর এক অভিযোগের তদন্তভার আদালতের নির্দেশে সিবিআইয়ের হাতে গিয়েছে। আনিস খান হত্যা, বগটুই থেকে হাঁসখালির ঘটনায় বারবার অভিযোগের আঙুল উঠেছে শাসক শিবিরের দিকে।

তার মধ্যেই বাংলার বাইরেও ত্রিপুরা এবং গোয়ায় পদক্ষেপ করেছে তৃণমূল। ত্রিপুরার পুরভোটে ভোট শতাংশের বিচারে ফল সন্তোষজনক বলেই অভিমত দলের নেতাদের। কিন্তু গোয়ায় ফল শোচনীয়। তবে তাতে দমে না-গিয়ে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে ডানা মেলছে মমতার দল।

রাজ্যের বিভিন্ন ঘটনাজনিত অস্বস্তি রয়েছে এবং থাকবেও। যেমন থাকবে গোয়ার ব্যর্থতার কাঁটা। তবু এই এক বছর নিঃসন্দেহে বাংলার মেয়ের রাজনৈতিক ভাবে এগিয়ে যাওয়ার ৩৬৫ দিন। যে অগ্রগতিতে তাঁর আশপাশে কেউ নেই।

বাংলা যে নিজের মেয়েকেই চায়, তা এক বছর আগের এই দিনটিতে সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হয়েছিল। কিন্তু গোটা দেশ কি বাংলার মেয়েকে চাইবে?

পরের দুটো ২ মে পর্যন্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চ্যালেঞ্জ সেটাই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement