(বাঁ দিকে) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় (ডান দিকে)। —গ্রাফিক সনৎ সিংহ।
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সাময়িক ছুটি’তে যাওয়ার ‘বাসনা’ নিয়ে তৃণমূলের অন্দরে বিবিধ জল্পনা তৈরি হয়েছিল। তবে সবচেয়ে বেশি করে শোনা গিয়েছিল, সরকারের কাজ নিয়ে তৃণমূলের সেনাপতির অসন্তোষের কথা। সেই সময়েই অভিষেক-ঘনিষ্ঠেরা ঘরোয়া আলোচনায় জানিয়েছিলেন, সেনাপতি চান নবান্নেও কার্যকর হোক ক্যামাক স্ট্রিট মডেল। অর্থাৎ কাজ করলে পদে থাকো, নইলে রাস্তা দেখো। সোমবার পুরসভার পরিষেবা নিয়ে নবান্নের বৈঠকে আমলা, পুলিশ, মন্ত্রী, কাউন্সিলর, বিধায়কদের যে ভাষায় মুখ্যমন্ত্রী তুলোধনা করেছেন এবং প্রশাসনের বড় অংশকে যে ভাবে পরীক্ষায় বসানোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, তা দেখে অনেকেই মনে করছেন, প্রশাসনিক কাজে ক্যামাক স্ট্রিট মডেল বোধহয় চালু হয়ে গেল।
তবে সোমবারের ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বৈঠকের পর তৃণমূলের অন্দরে কান পাতলে তিনটি অভিমত উঠে আসছে। ওই বৈঠকের পরে শাসক শিবিরে খোঁজখবর নিয়ে তেমনই জানা যাচ্ছে। তবে কেউই আনুষ্ঠানিক ভাবে ওই বিষয়ে কিছু বলতে রাজি নন। পুরোটাই দাবি এবং ব্যাখ্যার মোড়কে রয়েছে।
প্রথমত, অনেকের মতে, অভিষেক যে মডেলে সংগঠন পরিচালনা করেন, অনেকদিন ধরেই তিনি চাইছিলেন সরকারেও সেই প্রক্রিয়া শুরু হোক। কিন্তু তা হচ্ছিল না। সোমবার তার সূচনা হয়ে গেল। দ্বিতীয়ত, অনেকে বলছেন, সোমবারের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী পুর এলাকায় দুর্নীতি, তোলাবাজি, বেআইনি নির্মাণ, শহরগুলির নিকাশি ব্যবস্থার বেহাল দশা, অপরিচ্ছন্নতা, জমিদখল, বেআইনি পার্কিং থেকে টাকা তোলা ইত্যাদি নিশানা করেছেন। কিন্তু যে পুর দফতরের কাজ নিয়ে এত অভিযোগ, সেই দফতরের মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিমকে লক্ষ্য করে একটি শব্দও বলেননি। অতএব, নবান্নে ক্যামাক স্ট্রিট মডেল চালু করার বার্তা দিলেও ‘আসল’ বিষয়টি পিছনে থেকে গিয়েছে। তা হল ‘পারফরম্যান্স’। তৃতীয় অভিমত হল, এর মধ্যে কোনও ‘বনাম’ বাদ নেই। পুরোটাই নেত্রী এবং সেনাপতির বোঝাপড়ার ফসল। তৃণমূলের অন্যতম মুখপাত্র অরূপ চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘বিষয়টির মধ্যে মমতাদি বনাম অভিষেক না দেখে মমতাদি এবং অভিষেক দেখা উচিত। মমতাদির অভিজ্ঞতা এবং অভিষেকের আধুনিক ধাঁচের বাস্তবমুখী সংগঠন পরিচালনার মধ্য দিয়েই তৃণমূল এগিয়ে চলেছে। সরকার এবং সংগঠন পরিচালিত হচ্ছে সমন্বয় রেখেই।’’
সদ্যসমাপ্ত লোকসভা ভোটে গ্রামাঞ্চলে তৃণমূলের দাপট অটুট থাকলেও শহরাঞ্চলে তাদের সমর্থনের ভিত আলগা হয়েছে। যা ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগে শাসকদলের জন্য ‘অশনি সঙ্কেত’ বহন করছে বলে দলের একাংশেও আলোচনা শুরু হয়েছে। ফলে ভোট মিটতেই প্রশাসনিক স্তরে ‘ঝাঁকুনি’ দেওয়া শুরু করেছেন মমতা। যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে পুর ও নগরোন্নয়ন দফতর। সোমবারের বৈঠকে আমলাদের উদ্দেশে মমতা বলেছেন, তাঁদেরও আতশকাচের নীচে থাকতে হবে। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘‘অফিসারেরা ভাবেন দু’বছর কাজ করে চলে যাবেন। ফলে তাঁর কোনও দায় নেই। এ বার তা হবে না। তাঁদেরও ভিজিল্যান্সের মধ্যে কাজ করতে হবে। জবাবদিহি করতে হবে।’’ কারা নজরদারি করবে? সে ব্যাপারে সিআইডি, আর্থিক দুর্নীতিদমন শাখা, নিরাপত্তা বিষয়ক সংস্থাকে জুড়ে দেওয়ার কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
মন্ত্রী, বিধায়ক, কাউন্সিলরদের উদ্দেশে মমতা স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘‘আমি টাকা তোলার মাস্টার চাই না। আমি জনসেবক চাই। যারা জনসেবা করতে পারবে, তারাই আগামী দিনে টিকিট পাবে। বাকিদের ছুড়ে ফেলে দেব।’’ পুলিশকেও ‘কড়া’ হওয়ার বার্তা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, ‘‘অন্যায় করলে ব্যবস্থা নিন। কোনও দল, পদ দেখবেন না। যারা বেশি লোভ করবে, তাদের মুখে ললিপপ লাগিয়ে দিন। অথবা লিউকোপ্লাস্ট লাগিয়ে দিন।’’
তবে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠক নিয়ে কটাক্ষ করেছেন বিরোধীরা। বিজেপি মুখপাত্র রাজর্ষি লাহি়ড়ী বলেন, ‘‘হাতির যেমন খাওয়ার এবং দেখানোর দু’রকম দাঁত রয়েছে, তেমনই মমতারও কথা দু’রকম। একটা প্রকাশ্যে বলেছেন। আর আড়ালে বলবেন, যা বলেছি ভুলে যা। যেমন চালাচ্ছিস চালিয়ে যা।’’ সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘‘এমন ঠেলা পড়েছে যে, ঘুরিয়ে নিজের সরকার, নিজের মন্ত্রিসভাকেই তোলাবাজ আখ্যা দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী।’’
পক্ষান্তরে, তৃণমূলে অভিষেক-ঘনিষ্ঠ এক নেতার বক্তব্য, ‘‘নবান্ন আসলে ভারসাম্য রক্ষা করতে চেয়েছে। এ দিকও রইল, ও দিকও রইল।’’ তাঁর কথায়, ‘‘ববিদার দফতর নিয়ে এত কিছু! কিন্তু তাঁকে আগলে রাখা হল। অভিষেক তো চান পুরো সময়ের মেয়র এবং পুরো সময়ের পুরমন্ত্রী। সেটা হচ্ছে কই?’’ উল্লেখ্য, অভিষেক সংগঠনের দায়িত্ব নেওয়ার পরে দলে ‘এক ব্যক্তি, এক পদ’ নীতি বাস্তবায়িত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিবিধ ‘বাধা’য় তা কার্যকর করতে পারেননি। তবে অভিষেক-ঘনিষ্ঠ অনেকে আবার পাশাপাশিই বলছেন, ‘‘এত দিন কিছুই হচ্ছিল না। আজ অন্তত শুরুটা হল।’’
শুরু তো হল। শেষ কোথায় হয়, আপাতত তার দিকেই তাকিয়ে শাসক শিবিরের বিভিন্ন স্তম্ভ।