উদ্ভাবনী চিন্তা কাজে লাগিয়ে বিকল্প ও নতুন প্রকল্প খোঁজার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। প্রতীকী ছবি।
উলটপুরাণ!
রাজ্যের নানা প্রকল্পে বরাদ্দ আটকে রাখা ঘিরে তৈরি চাপানউতোরে কেন্দ্র-রাজ্যের সম্পর্ক বিভিন্ন সময়ে তিক্ত হয়েছে। রাজ্যের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় বরাদ্দ আটকে থাকায় প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা, একশো দিনের কাজ থমকেছে। কেন্দ্রের পাল্টা দাবি, বরাদ্দ আটকে রাখার কারণ, দুর্নীতির অভিযোগ।
অথচ এ রাজ্যেই হাতের সামনে এমন প্রকল্প মজুত, যেখানে টাকা অঢেল। শৌচাগার নির্মাণ, বর্জ্য-নিকাশি ব্যবস্থা তৈরি, পানীয় জলের মতো কাজগুলিতে তিন-তিনটি প্রকল্পের টাকা ‘দুয়ারে’ অপেক্ষায় রয়েছে। অথচ প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকেরাই স্বীকার করছেন, ওই টাকা খরচ করার মতো পর্যাপ্ত প্রকল্প নেই! ফলে বাকি প্রকল্পে যেখানে বরাদ্দের জন্য হাহাকার, অঢেল বরাদ্দের পরেও কোথায় তা খরচ হবে তার খোঁজেই এই ক্ষেত্রে হাহাকার। তাই উদ্ভাবনী চিন্তা কাজে লাগিয়ে বিকল্প ও নতুন প্রকল্প খোঁজার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
কেন এমন পরিস্থিতি?
পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের শর্ত, বরাদ্দের ৬০ ভাগ টাকা (এ বছরের হিসাবে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা) খরচ করা যাবে নির্দিষ্ট খাতেই। বাজেটের পরিভাষায় যার নাম ‘টায়েড ফান্ড’। এর অর্ধেক অর্থ নির্দিষ্ট পানীয় জল (জল সরবরাহ, জল পরিশোধনের পরিকাঠামো নির্মাণ) এবং বাকিটা নিকাশি-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা (কঠিন, তরল, প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিকাঠামো এবং শৌচাগার নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ) খাতে। জেলা-কর্তারা জানাচ্ছেন, ওই টাকায় গভীর/অগভীর নলকূপ, জল সরবরাহের ও পরিশোধনের পরিকাঠামো ইত্যাদি তৈরি হয়।
জল জীবন মিশনের অর্থেও কার্যত একই ধরনের কাজ হচ্ছে। আবার অর্থ কমিশন এবং স্বচ্ছ ভারত মিশনের বরাদ্দে শৌচাগার, নিকাশি নালা, বর্জ্য ব্যবস্থা পরিকাঠামো তৈরির কাজও চলছে। অর্থাৎ, একই কাজের অর্থ থাকছে একাধিক তহবিলে। তাই কোনও একটি তহবিল থেকে সেই খরচ হলে অন্যটির অর্থ অব্যবহৃত থাকে। অথচ প্রয়োজনের অতিরিক্ত জল, নিকাশি-বর্জ্যের পরিকাঠামো তৈরিও সম্ভব নয়। ফলে সীমাবদ্ধতা থাকছে কাজে।
পঞ্চায়েতমন্ত্রী প্রদীপ মজুমদারের কথায়, “আগে তো জলজীবন মিশন ছিল না! এখন খরচ না হওয়ার সুসংহত যুক্তি এবং কারণ বোঝা যাচ্ছে। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখে দরকারে কেন্দ্রের সঙ্গে আলোচনাও হবে।”
দফতরের এক কর্তা বলেন, “নতুন কাজের উদ্ভাবন করা খুব জরুরি। অথবা যে কাজে টাকা খরচ করা অর্থহীন, তা বন্ধ করে ভিন্ন ভাবে ব্যবহারের অনুমোদন কেন্দ্রের থেকে নেওয়া হলে রাজ্যেরই সুবিধা হবে।”
বস্তুত, ২০২১-২২ থেকে ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষের মধ্যে অর্থ কমিশনের মোট ১০,৩২০ কোটি টাকা পাওয়ার কথা। ২০২২-২৩ বছরের নির্ধারিত খাতে প্রথম কিস্তির প্রায় ৯৯৭ কোটি টাকা পেয়েছে রাজ্য। এতে জেলা পরিষদগুলির মোট বরাদ্দ ১৪৯.৪৮ কোটি টাকা। পঞ্চায়েত সমিতিগুলিও পাচ্ছে সমপরিমাণ। গ্রাম পঞ্চায়েতগুলি মোট পাবে প্রায় ৬৯৭.৫৯ কোটি। তা ছাড়া, জলজীবন মিশনে রয়েছে মোট প্রায় ৫৮ হাজার কোটি (কেন্দ্র-রাজ্যের ৫০% করে) টাকা। ২০২২-২৩ বছরে রাজ্য পেয়েছে প্রায় ছ’হাজার কোটি টাকা। রয়েছে স্বচ্ছ ভারত মিশনের বরাদ্দও। প্রসঙ্গত, অর্থ কমিশনের পুরনো বরাদ্দের অব্যবহৃত প্রায় ২৪৪৬ কোটি টাকা খরচের ব্যাপারে আগেই জেলাগুলিকে সতর্ক করেছে রাজ্য।
এক কর্তার কথায়, “বড়-মাঝারি জেলাগুলি তুলনায় বেশি অর্থ পায়। জলের কাজগুলি কম খরচের হওয়ায় অত টাকা খরচ করা কঠিন। নিকাশি-বর্জ্য বা জল পরিশোধনের পরিকাঠামো একটা জায়গায় কতগুলো তৈরি করা সম্ভব? নির্ধারিত খাতের বরাদ্দ না হলে বরং তা সড়ক বা অন্যান্য পরিকাঠামো তৈরি এবং সংরক্ষণে কাজে লাগে।”
প্রশ্ন উঠছে, এই পরিকল্পনার দায় কার? বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, অর্থ কমিশনের বরাদ্দ পেতে বছর শুরুর আগেই কাজের পরিকল্পনা করেন ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েতের নির্বাচিত সদস্যেরা। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির স্বার্থে চটজলদি এবং চোখে পড়ার মতো প্রকল্পগুলিই বেশিরভাগ তালিকাভুক্ত হয়। এখানে আধিকারিকদের ভূমিকা অনেকটাই সীমিত। বদলে, দীর্ঘকালীন ও স্থায়ী উন্নয়নের লক্ষ্যে কোনও পরিকল্পনায় কেন্দ্র উৎসাহ দিলে অর্থের যথাযথ ব্যবহার সম্ভব। এক জেলা-কর্তার কথায়, “একেকটা পঞ্চায়েতে যা টাকা পাওয়া যায়, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনায় তাতে মানুষের সব চাহিদা মেটানো সম্ভব।”