শহর জুড়ে প্রতিবাদ। —ফাইল ছবি।
শিক্ষক দিবস তো প্রতি বছরই আসে, কিন্তু ক'জন শিক্ষার্থী নিজের ভাল রেজাল্টের জন্য শিক্ষকদের পা ছুঁয়ে প্রণাম করে বলে, 'আপনার কাছে শিখতে পেরেছি, আমার অনেক বড় প্রাপ্তি। আদর্শ শিক্ষক স্মরণে সভা হয়, কিন্তু আদর্শ ছাত্রী? আজ, বৃহস্পতিবার শিক্ষক দিবসে প্রিয় ছাত্রী তাঁর শিক্ষকদের স্মরণে, মননে।
আর জি কার নির্যাতিতার চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্রী হিসেবে হাতেখড়ি ২০১১ সালে কল্যাণী জেএনএম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এমবিবিএস ডিগ্রি পাওয়ার পরে অ্যানাটমি ডেমনস্ট্রেটর হিসেবে স্বল্প সময়ের শিক্ষকতাও (২০১৭-১৮) এই হাসপাতালেই। স্বল্পভাষী, বিনয়ী এবং রোগী থেকে রোগীর পরিজন, সবার কাছেই জুনিয়র রেসিডেন্ট চিকিৎসকটি বড়ই আপনার জন ছিলেন। তাই আর ডি কর মেডিক্যাল কলেজে এমডি পড়তে চলে যাওয়ার পরেও রোগীর পরিবারের তরফে তাঁর খোঁজ নেওয়া হত বার বার। অনেক কথার মধ্যে এই টুকরো টুকরো ঘটনাগুলো মনে পড়ে যায় জেএনএম-এর প্রাক্তন অধ্যক্ষ সুবিকাশ বিশ্বাসের। প্রিয় ছাত্রীকে কেন এমন নৃশংস ভাবে মেরে ফেলা হল, সেই সত্যিটা জানতে চাওয়ার অপেক্ষায় সুবিকাশ। হাসপাতালের বহির্বিভাগে রোগী দেখতে দেখতে বলেন, "শিক্ষক দিবসে সকালবেলা এসে দেখা করেই পা ছুঁয়ে প্রণাম করত। মৃদু মৃদু আপত্তি আ করলে বলত, 'শিক্ষক তো অভিভাবক, বাবা-মায়ের মতো। যেটুকু ভাল, যেটুকু হতে পেরেছি, সবটাই যে আপনাদের জন্য।' ভাল ছাত্রী ছিল। তার থেকেও বেশি ভাল মানুষ ছিল। এই দিনটা সারা জীবন আমাকে মনে করাবে ওর কথা।"
এমবিবিএস-এর দ্বিতীয়- তৃতীয় বর্ষে মাইক্রোবায়োলজির শিক্ষিকা ছিলেন চিকিৎসক মৌমিতা চট্টোপাধ্যায়। মৌমিতা তাঁর প্রিয় ছাত্রীর পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেছেন। সত্য উদ্ঘাটন ও বিচারের দাবিতে সক্রিয় ভাবে আন্দোলন করছেন। মৌমিতার কথায়, "দু'ভাবে আমি ওকে পেয়েছিলাম। খুব ভাল ছাত্রী, যে পড়তে ভালবাসে, জানতে চায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের খুঁটিনাটি। আর, পরে এক জন নরম মনের সহকর্মী হিসেবে। আমরা একসঙ্গে অ্যানাটমি পড়িয়েছি। ওর শিক্ষক হিসেবে আমার চাওয়া একটাই। যে চক্রটা আমার ছাত্রীকে নির্দ্বিধায় শেষ করে ফেলল, তাদের শেষ দেখে ছাড়ব।"
জেএনএম-এর মেডিসিন বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক-চিকিৎসক প্রবীর গঙ্গোপাধ্যায়েরও মন ভাল নেই শিক্ষক দিবসে। স্ত্রী ও মেয়ে দু'জনেই চিকিৎসক। বৃদ্ধ চিকিৎসক বলেন, "আমার মেয়ের মতো ছিল। প্রাইভেট টিউশন নিতে আসত বাড়িতে। নিবিড় সম্পর্ক ছিল মেয়ে ও স্ত্রীর সঙ্গে। শেখার আগ্রহ এত বেশি, খুব কম শিক্ষার্থীর মধ্যে থাকে। শিক্ষক হিসেবে ওকে পড়িয়েও গর্ব হত। আজ ও নেই, এটা মানতে কষ্ট হচ্ছে যেমন, তেমনই এ রাজ্যের এক জন চিকিৎসক হিসেবে লজ্জা হচ্ছে। মাথা নিচু হয়ে যাচ্ছে অন্য রাজ্যে গিয়ে পরিচয় দিতে।"
চিকিৎসক কেশব মুখোপাধ্যায়ও দীর্ঘ দিন অধ্যক্ষ ছিলেন জেএনএম-এ। প্রিয় ছাত্রীর কথা বলতে গিয়ে মাঝে মাঝে থমকে যান। আবার কখনও নাগাড়ে বলেন, 'অধ্যক্ষ হিসেবে দেখেছি এক জন আদর্শ ছাত্রীকে। সব শিক্ষকেরই প্রিয় ছাত্রী ছিল ও. শুধুমাত্র জানার আগ্রহ আর বিনয়ের জন্য। হস্টেল সুপারও ছিলাম এক সময়ে ওদের। তখন তো ছেলেরা নীচের তলায় আর মেয়েরা উপরের তলায় থাকত। কই, কোনও আইন করে, নিয়ম করে ছেলে-মেয়ের মধ্যে বিভাজন করার মতো ভাবনা তো ভাবার প্রয়োজন হয়নি। আজ চোখে আঙুল দিয়ে অনেক কিছু দেখিয়ে দিয়ে গেল আমাদের প্রিয় ছাত্রী। এই শিক্ষক দিবস সেটাই স্মরণ করার দিন।" ফিজিয়োলজির অধ্যাপক তথা আর এক প্রাক্তন অধ্যক্ষ সুব্রত চট্টোপাধ্যায় বললেন, "আজ আসলে শিক্ষক হিসেবে আমাদের ব্যর্থতা স্বীকারের দিন। নিজের মেরুদণ্ডটা খুঁজছি, জানেন। কিন্তু পাচ্ছি না তো!'